অষ্টম শ্রেনীতে তাই বাবা যখন বললেন বৃত্তি পেলে একটা সাইকেল কিনে দেবেন জাবের তখন কথাটায় খুব একটা বিশ্বাস রাখতে পারে নি । তবুও তার মনে যে একটা ক্ষীণ আশা ছিল না তা নয় । ছাত্র হিসেবে সে খুব একটা খারাপ না হলেও অন্তত জেলা শহর থেকে বৃত্তি পাওয়ার মত একজন নয় । বৃত্তিটা পেলে সেটা তার কাছে একটা অনাকাঙ্খিত বিষয় তো হবেই বাবা মা ও নিশ্চই খুশিই হবেন । তখন একটা সামান্য সাইকেল দেওয়া তাদের জন্য এমন বিচিত্র কিছু হবে না । জাবেরর মনে এতটুকু ক্ষীণ আশা ছিলই তাই সে বছরের প্রথম থেকে পড়াশুনায় বেশ মনোযোগ দিয়েছিল ।
সে বছর জাবের সরকারী বৃত্তিটা পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার আশাটা আর পূর্ণ হয় নি । সাইকেল নিয়ে প্রাইভেটে ব্যাচে যাওয়ার , এই একটু বিকেল বেলায় নদীর ধারের রাস্তাটা দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সাধটা তার অচিরেই মারা পড়ল । সাইকেল নিয়ে শহরের ব্যস্ত গাড়িঘোড়ার রাস্তায় চলতে সমস্যা হবে , পড়াশুনা কমিয়ে সারাদিন পইপই করে ঘুরবে এরকম নানান অজুহাত দেখিয়ে বাবা মা আর সাইকেলের রাস্তায় গেলেন না । সাইকেলের বদলে একটা সোনার চেইন কিনে দিলেন জাবেরকে । সোনার চেইনটা নিয়ে জাবের এক মহা সমস্যায় পড়ল । একে তো সে পুরুষমানুষ আর পুরুষমানুষের সোনাই যেখানে পরা ধর্মমতে ঠিক নয় তখন এই অল্প বয়সেই কেন তাকে এরকম একটা চেইন পড়তে দেয়া হল এটার কোন কূল-কিনারা করতে সে করতে পারল না । তারপরেও সোনার এই চেইনটা পড়তে সে রাজী ছিল , রাস্তাঘাটে সে দু-একজনকে এরকম চেইন পরে ঘুরতে দেখেছে কিন্তু বিপত্তি বাধাল চেইনের সাইজটা । চেইনটা এত বড় যে বলতে গেলে তার নাভি পর্যন্ত চলে আসে । বাবা মা দিয়েছেন কি আর করা যাবে চেইনটা সে তাই দু-চারদিন পরল । কিন্তু বন্ধুদের যন্ত্রনা যখন চরমে পৌছাল তখন মাকে চেইনটা দেওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় রইল না । মা ও চেইনটা কোন কথা ছাড়া নিয়ে নিলেন । কে জানে হয়ত নিজের জন্যই কিনেছিলেন ! জাবের এটাই ভাবল আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল বাবা মার কোন প্রতিশ্রূতির আশা করা যাবে না । সান্ত্বনার একটা উপলক্ষ্য অবশ্য সে কয়েকদিন পরেই পেয়েছিল । নীল পাথর বসানো সোনার একটা আংটি দেওয়া হল এবার তাকে । অফিস থেকে ফিরে কলার থোড়ের মত লাল একটা বাকসের ভিতর থেকে আংটিটা বের করেছিলেন বাবা। আংটিটা পেয়ে জাবের একটু অবাকই হল । আংটির পাথর সাধারণত হাল্কা নীল বা খয়েরী বর্ণের হয় । তারটা গাঢ় নীল বর্ণের কেন এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারল না । অবশ্য এই আংটিটার জন্য যে তাকে সামনের জীবনে খানিকটা ঝামেলা পোহাতে হবে তা তখনও সে জানত না ।
জাবের আংটিটা অনামিকাতেই পড়েছিল । অবশ্য কেউ তাকে সে সময় বলে দেয় নি অনামিকায় আংটি পরার একটা অন্য অর্থ আছে । ছোট বলেই হয়ত কেউ বলেনি । তবে যে সময় সে প্রথম কথাটা শোনে সে সময় সবেমাত্র তার সর্বনাশ হতে শুরু হয়েছে এবং এটা থেকে পরিত্রানটা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে ।
কলেজে পড়ার সময়ই জাবের বাবাকে হারায় । পরের কয়েকটা বছর তাই সে খুব একটা সুবিধার মধ্যে পার করতে পারে না । বাবার সামান্য পেনশনের টাকায় নিজের , ছোট ভাইদের পড়াশুনা আর পরিবারকে চালিয়ে নিতে তাকে হাপিয়ে উঠতে হয়,ধরতে হয় টিউশনি । এসময় একেকটা দিন যেন একেকটা বছর মনে হতে থাকে তার কাছে । অবশ্য এ অবস্থায় তাকে বেশীদিন কাটাতে হয়নি । গ্রামের বাড়িতে নদীর মধ্যে থাকা জমিগুলো চর হয়ে জেগে ওঠাতেই যা রক্ষে । ওসব আধিয়ারদের দিয়ে যা টাকা-পয়সা পাওয়া যায় তাতে ওদের ভালই চলতে শুরু করে । ক্রান্তিকালের ঐ কয়েকটা বছরে তাকে দেখে হয়ত সবাই খানিকটা সহানুভূতিতে ভুগত , তাই হয়ত অনামিকার আংটিটার দিকে কেউ নজর কেউ কখনও দেই নি ।
অনামিকার আংটিটার দিকে যাদের নজর দেয়ার কথা ছিল তারাই অবশ্য প্রথম নজর দেয় , বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা । কিসের জন্য আংটি পরেছিস ? বিয়ে করেছিস ? এগেজড ? নাইলে কে দিল ? নানান প্রশ্ন । প্রথমদিকে অবশ্য সবাইকে সে খানিকটা সময় নিয়ে আংটির বিষয়টা বলত পরে হাল ছেড়ে দিয়েছে । হেসে বলে হ্যাঁ বিয়ে করেছি বা বিয়ে হবে হবে করছে । যদিও বিয়ে করা বা বিয়ে হবে হবে করা থেকে সে অনেকটা দূরেই ছিল সবসময় । আংটিটার জন্যই কিনা কে জানে মেয়েরা তার সাথে কখনো ভালভাবে মেশে নি !
একবার সে অবশ্য আংটিটা খোলার কথাও ভেবেছিল কিন্তু প্রায়াত বাবার শেষ স্মৃতির কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত খুলতে পারে নি । তবে অনামিকায় থাকাতেই যখন সমস্যা তখন এটাকে অনামিকা থেকে খুলে মধ্যমা বা অন্যকোন আঙুলে পরার কথাও সে একবার ভেবেছিল । শেষ পর্যন্ত এটাও হয়নি । সাত-আট বছর আগে পরা আংটি । এতদিনে তার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আঙুলের বয়সও বেড়েছে , বেশ মোটাই হয়েছে আঙুল । অন্য আঙুলে পরা তো দূরের কথা সাবান দিয়ে ঘঁষেও অনামিকা থেকে আংটিটা খুলতে পারেনি । অবশেষে সে হাল ছেড়ে দিয়েছে , মনস্ত করেছে থাকুক অনামিকাতেই থাকুক বাবার স্মৃতিটা । বিয়ে করলে দরকার হলে বিয়ের আংটিটা অন্য আঙুলেই পরবে । আংটিটার যত্নেরও সে কোন ত্রুটি করে নি । দীর্ঘদিন ব্যবহারে আংটির গাঢ় নীল পাথরটা খনিকটা বিবর্ণ হয়ে গেলে সে এটাকে পাল্টিয়ে গাঢ় নীলের একটা পাথর বসিয়ে নিয়েছে ।
এমনিতেই আংটিটা নিয়ে জাবেরের কোন সমস্যা ছিল না , দুই একজন মজা করে বিয়েসাদি নিয়ে এটাওটা বলে তো বলুক সমস্যা নেই কিন্তু জাবেরের অন্য একটা কাজে আংটিটা বাধা হয়ে দাড়াল । বিয়ে করার জন্য জাবেরের একটা মেয়ের সাথে খনিকটা পরিচিত হওয়া বা আরও ব্যাপকভাবে বলতে গেলে প্রেম করা খুব দরকার হয়ে পড়েছিল । জাবেরের বাবা মা সেই কোন দশকের রক্ষনশীল সমাজে প্রেম করে বিয়ে করেছিল । তাই এই দশকের ছেলে হিসেবে তারও প্রেম করে বিয়ে করা বা নিদেনপক্ষে কিছুদিন জেনেশুনে একটা মেয়েকে বিয়ে করা প্রায় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে । জাবের এটা বুঝেছে , বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যায়ে এসে এটাও বেশ ভালভাবেই বুঝেছে যে স্বাভাবিকভাবে যেভাবে প্রেম বা ভাবভালবাসা হয় তার এভাবে ওরকম কিছু হবে না , বিশেষত এ পর্যন্ত তার যখন কোন বান্ধবি পর্যন্ত কেউ একজন নেই ।
অগত্যা নিরূপায় তরুনের শেষ পথ হিসেবে সে ইন্টারনেটকেই বেছে নিয়েছে । আর কে না জানে এসব পথে জাবেরের মত তরুনদের জন্য মেয়েদের অভাব কখনো হয় নি । জাবেরেরও অবশ্য খুব একটা সময় লাগেনি । কিছুদিন একজনের সাথে ভাল ঘনিষ্টতার পর একজন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আজকালের ছেলেদের মত সে কানে সোনার দুলটুল পরে কি না ? জাবের নির্দোষ জবাব দিয়েছিল সেটা সে পরে না তবে সোনা যে একেবারে পরে না তা নয় একটা আংটি পরে । মেয়েটা জানতে চেয়েছিল কোন আঙুলে সে আংটিটা পরে । জাবের হুট হাট মিথ্যা বলতে পারে না অথবা সে ভেবেছিল আঙুলের কথাটা বলুক পরে কারনটা বলবে । কিন্তু মেয়েটা অনামিকার কথাটা শোনার পর আর বেশী দেরী করে নি । জাবের অবশ্য যোগাযোগের চেষ্টা খনিকটা যে করে নি তা নয় , লাভ হয়নি । জাবের সান্ত্বনা খুঁজেছে । ক বলতে কলিকাতা শোনার অভ্যাস এ দেশের লোকজনের বহু দিনের স্বভাব , খামাখা মেয়েটাকে দোষ দিয়ে কি লাভ ? অবশ্য জাবেরের মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল । পাশ করার পর অফিসে-আদালতে নিশ্চই হবে , কিছু একটা হবে । কিন্তু সে সবে গিয়ে সে দেখেছে কেউ আর তাকে বিয়ের কথাই জিজ্ঞাসা করে না । হয়ত এটা একটা খুবই ব্যক্তিগত একটা প্রশ্ন , জিজ্ঞাসা করতে লোকজনের রুচিতে বাঁধে অথবা সবাই তার অনামিকাতে আংটি দেখে বুঝেছে সে বিবাহিত । কেইবা জানে এই কুফা আংটির ফল তাকে কতদিন বয়ে বেড়াতে হয় ?