যাপিত জীবন-০৬ : : আপনার আরডস নাম্বার কত ?

<১> কয়েকদিন আগে গ্রাফ থিওরির ক্লাসে স্যার জিজ্ঞাসা করলেন তোমাদের কারও কি নিজের আরডস নাম্বার জানা আছে । আমরা আকাশ থেকে পড়লাম । কে এই আরডস ? আমাদের কাছে কি আদৌ তার কোন নাম্বার থাকার কথা ? থাকলে জানি না কেন ? মহাখাপ্পা বিষয় হয়ে যাচ্ছে না ! তবে স্যার যখন জিজ্ঞাসা করছেন তখন নিশ্চই আমাদের আছে ! আমরা সবাই আরডস নাম্বার থেকেও না জানার বিহবলতা থেকে তার দিকে তাকালাম । স্যার বলতে শুরু করলেন ।

আরডস সাহেব একজন হাঙ্গেরিয়ান গণিতবিদ । গণিতবিদ তো কি হয়েছে ? কেন তার নম্বর থাকবে ? আসলে আরডস সাহেব ছিলেন একজন অমানুষিক(!) গণিতবিদ । ওনার ১৫০০ খানা গণিত বিষয়ক রিসার্চ পেপার আছে । যারা রিসার্চ কাজে আছেন তারা জানেন এতখানা বিসার্চ পেপার থাকার মানে কি ! আরডস এই বিশাল কাজগুলো করেছেন ৫১১ জন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে । এই সাঙ্গপাঙদের আরডস নাম্বার ১ আর আরডস সাহেবের নিজের আরডস নাম্বার ০ । আরডস নাম্বার ২,৩ এগুলো তাহলে কাদের । আরডস নাম্বার ২ হল তাদের যারা আরডসের সাঙ্গপাঙদের সাথে অন্তত একখানা পেপার বের করতে পেরেছেন যদিও এরা সরাসরি আরডসের সাথে কোন কাজ করেন নি । এভাবে আরডস নাম্বার ৩ কাদের সেটা এখন নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন ।

স্যার এটা বলার পর আমরা বুঝে গেলাম যে আমাদের আরডস নাম্বার ১ হওয়ার কোন কারন নেই কারন আরডস সাহেবের সাথে কাজ কোনদিন করেছি বলে মনে পড়ে না ! আরডস নাম্বার ২,৩,৪ কিছু একটা হওয়ার কারন থাকতে পারে কিন্তু সেটা নির্ভর করছে স্যারের উপর । অনেকেই তো ওনার আন্ডারে থিসিস করছি । যা-তা করে খেটেখুটে স্যারের সাথে একটা পেপার বের করলেই হল । ব্যস আরডস নাম্বার আর ঠেকায় কে ? স্যারের আরডস নাম্বারের সাথে ১ যোগ করলেই হবে । আমরা আরডস নাম্বার প্রাপ্তির আশায় স্যারের মুখের দিকে তাকালাম । স্যার বললেন তার আরডস নাম্বার ৩ হতে পারে । মুখটা চকচক করে উঠল আমাদের । ৪ আরডস নাম্বার প্রাপ্তি তাহলে সময়ের ব্যাপার মাত্র ? যাক না আর কয়েকটা দিন ।

<২> আরডস সাহেবের কিছু মহান উক্তি -

১। শিশুরা হল এবসাইলন (গণিতে ক্ষুদ্র ধনাত্বক মান সূচিত করতে এবসাইলন ব্যবহৃত হয়) ।

২। নারীরা হল বস(Boss) , নররা কৃতদাস (!)।

৩। যে গণিত করা বন্ধ করেছে সে মৃত ।

৪। বিবাহিত পুরুষ বন্দী ,অবিবাহিত পুরুষ মুক্ত ।

৫। সঙ্গীত মানে হল গোলমাল , কলরব , অহেতুক শব্দ । বাকিটুকু পড়ুন...

বোয়াল

আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমি একবার মাছ ধরতে যাই । এটাকে অবশ্য মাছ ধরা না বলে মাছ দেখাও বলা যেতে পারে । আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল জ্যোসনা রাতে করতোয়ার বোয়ালরা তীরের খুব কাছাকাছি চলে আসে । পানিতে তাকালে নাকি বোয়ালের জ্বলজ্বল করা রূপালী চোখ দেখা যায় । রূপালী চোখ নিয়ে বোয়ালরা যখন চারপাশে ঘুরে বেড়ায় তখন যে দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তার নাকি কোন তুলনা নাই । বোয়ালের এই চোখ দেখার উদ্দেশ্য নিয়েই আগষ্ট মাসের হাল্কা গরমের এক রাতে করতোয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম ।

নজুপুর হাটের পাশেই এই করতোয়া নদী । হাটসংলগ্ন তীরে নদীটা ক্রমশ ভাঙছে । দোকানীদের হয়েছে অসুবিধা । কিছুদিন পরপরই দোকান সামনে এগিয়ে নিতে হয় , নদী এগিয়ে আসে । করতোয়ার অপর তীরে দীর্ঘ চর । চরের মাটিতে আখ , চীনাবাদাম আর আলুর চাষ হয় । চর থেকে ওপারের গ্রাম্য হাটটা দেখতে ভালই লাগে । হাটের রাতে তীরসংলগ্ন দোকানগুলোর হ্যাজাক আর কুপির আলো দোকানের ফাঁকা ফাঁকা করে বসানো কাঠের চিরগুলোর মধ্য দিয়ে নদীতে এসে পড়ে । মনে হয় অজস্র জোনাকী যেন সার বেঁধে নদীর পানিতে এসে লম্বা লাইন দিয়েছে । আজও হাটবার ছিল । দেখতে দেখতে হাটটা ফাঁকা হয়ে গেল সন্ধ্যার পরপরই । গ্রামের হাট , বেশী রাত জাগার অভ্যাস নেই । হাট থেকে ফিরে আসা শেষ নৌকার লোকগুলোও চরের মধ্যে কিছুক্ষন বসে বিড়ি-সিগারেট খেয়ে ফিরে গেল । এই বিস্তীর্ণ চরে মানুষ বলতে গেলে এখন বোধহয় শুধু আমি আর রজব সরদার ।

রজব সরদারের বয়স প্রায় পয়তাল্লিশের কাছাকাছি । খাটো ,পাতলা টিঙটিঙে একজন লোক । এ বয়সে মাথার চুল কিছু পাকার কথা থাকলেও এনার চুল পাকে নি । রজবের বাড়ী এই করতোয়ার পাশেই কেবলাপুর গ্রামে । ঘরে জোয়ান ছেলেরা আছে । তারাই জমিজমা দেখাশুনা আর ক্ষেতখামারীর যাবতীয় কাজ করে । রজব সরদার মাছ ধরেন । মাছ ধরা তার পেশা নয় নেশা । যদিও রজবের কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায় কাজটা নিতান্তই শখের বশে হলেও বেশ মনযোগ দিয়েই পেশাদারিত্বের সাথে করেন তিনি । রজবের সাথে আমার প্রথম যখন এই অন্চলে এসে দেখা হয় তখন সে আমাকে বলেছিল , বুঝলেন মাছ ধরাটা হইল গিয়া একটা বদ নিশা , মদ আর মাইয়ামানুষের চাইয়াও খারাপ নিশা , সহজে ছাড়ান যায় না । যৈবনে যে একবার মাছ ধরে বুড়া বয়সে আইসাও তারে মাছ ধরতে হয় । আমি রজবের কথা শুনে সেসময়ে হেসেছিলাম ।

অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের রাত । সারাদিনে গরম থাকলেও রাতের বেলা দেখি চরে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব । উত্তরবঙ্গ , একখানে শীত বেশ তাড়াতাড়িই আসে । রজব আমাকে ফুলহাতা শার্টটার নিচে গেন্জিজাতীয় কিছু একটা পড়ে নিতে বলেন । আমি বলি কোন গেন্জি তো আনি নি । রাতে এরকম শীত পড়বে কে জানত ? রজব বলেন চিন্তা কইরেন না । চালা থেকে গিলাপ(চাদর) দিয়া দিমুনে ।

এই চরের মধ্যে রজবের চালা আছে জেনে আমি একটু আশ্চর্য হই । আরও আশ্চর্য হই চালার গঠনশৈলী দেখে । চালা ঘর বলতে যে রকম ঘর কল্পনায় চলে আসে সেরকম ঘর এটা নয় । কোন রকমে দুইজন মানুষ থাকার জন্য একটা কুঠুরিমতন জিনিস তৈরী করা হয়েছে আখের পাতা আর বাশের কঞ্চি দিয়ে । কয়েকটি কঞ্চি এক জায়গায় করে খুটির মত বানিয়ে উপরে আখের সরু পাতা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে । প্রথম দিন যখন রজবের সাথে এই চরে দেখা হয়েছিল তখন চালাটি চোখে পড়ে নি । আমি রজবকে বলি কি এখানে থাকেন নাকি ? রজব বলেন মাছ ধরন হইল গিয়া ধৈর্য্যের কাম । কতক্ষন আর ধৈর্য্য রাখা যায় । মাঝে মইদ্যে চালায় যাই , খানিকটা জিরায়া আসি। বাড়ী থাইকা আহনের সময় সাথে মশারী নিয়া আহি । মশার যন্ত্রনা আছে । চারপাশে টাঙায়া দেই । ইচ্ছে হইলে তাই ঘুমোনও যায় । রজব আমাকে চালার মধ্য থেকে চাদর বের করে দেন । চালার মধ্যে রজবের মাছ ধরার সামগ্রী আর কিছু শুকনা খাবারও দেখি । আমার আর তর সয়না বলি চলেন , মাছ ধরার আয়োজন শুরু করি । যদিও আমার উদ্দেশ্য মাছ ধরা নয় মাছ দেখা তারপরও রজবকে মাছ ধরার কথাই বলতে হয় । এই নিশুতি রাতে কেউ একজন মাছের চোখ দেখার জন্য এই চরে পড়ে আছে এটা শুনলে রজব নিশ্চই আমাকে পাগল ভাববে । রজব অনিকক্ষন কাশেন । চরের ঠান্ডা হাওয়ায় দিনের পর দিন থেকে হয়ত কাশি লাগিয়ে ফেলেছেন । কাশি থামানোর পর বলেন , চ্যাং দিলেও এহন কাম হইব না । মাছেরা মানুষের চাইতে রাত ভাল বোঝে , বেশী রাত না হইলে তীরের কাছে আহে না । চ্যাং শব্দটা আগে কোনদিন শুনেছি বলে আমি মনে করতে পারি না । রজবের কাছে জানতে চাই এই চ্যাংটা কি ? রজব বলেন , চ্যাং হইল গিয়া গড়াই মাছেরই একটা জাত । তয় এরা বেশী অস্থির । বরশীতে গাঁইথা পানিতে ছাইড়া দিলে খালি লাফায় । এদের বোয়াল কামুড় দিলেই বোয়াল শ্যাষ , বরশী ঢুইকা যায় বোয়ালের মুখের মইদ্যে ।

রজব চালাঘর থেকে চটের একটা বস্তা এনে চরের হাল্কা ভেজা বালিতে পেড়ে দেন । আমি বসি । রজব হুকায় টান দিতে থাকেন । এই দিনেও লোকজন হুকা খায় এটা আমার জানা ছিল না । আমি তন্ময় হয়ে রজবের হুকা খাওয়া দেখি । রজব গল্প জুড়ে দেন , নিতান্ত পারিবারিক গল্প ।

রাত গভীর হয়ে গেল রজব পলিথিনের একটা প্যাকেট থেকে চ্যাং বের করা শুরু করেন । প্যাকেটের পানিতে দেখি এরা ভালভাবেই বেঁচে আছে । রজবের কথাই ঠিক , এই মাছ অতিশয় অস্থির । হাতে নেয়ার সাথে সাথে মাথা ও লেজ একসাথে প্রবলবেগে নাড়াতে শুরু করে । রজব একটা একটা করে চ্যাং বরশীতে গাঁথেন । শরীরের মাঝামাঝি বরশী গাঁথার ফলে চ্যাং আরও বেশী করে লাফাতে শুরু করে । বরশীর সূতাটার আরেক মাথা বাঁধা হয় শক্ত বাশের কঞ্চির সাথে , নদীর পাড়গুলোতে এগুলো নাকি পোতা হবে । আমি আর রজব দুজনে মিলে সবগুলো কঞ্চিগুলো কিছুদূর ফাঁক ফাঁক করে করে তীরে গেড়ে আসি ।

আমরা চালার সামনে এসে বসে পড়ি । রজব আবার বলতে শুরু করেন , বুঝলেন তো মাছ ধরা হইল গিয়া ধৈর্য্যের কাম....... । হ্যাঁ , মাছ ধরা যে আসলেই চরম ধৈর্য্যের একটা কাজ সেই রাতে সেটা বুঝতে পারলাম হাড়ে হাড়ে । অনেকক্ষন আগে চ্যাংসমেত বরশী দেয়া হলেও সেগুলোতে কোন মাছ পড়ে না । আমি মাঝে মাঝে পানির কাছাকাছি গিয়ে টর্চ মেরে দেখি , বোয়ালের চোখ খুঁজি । রজব হয়ত মনে করেন মাছ পড়ছে না দেখে আমি অস্থির হয়ে পড়েছি । আমাকে বলেন , ঘুরনের কাম নাই আপনের , এইহানে আইসা বসেন । বোয়াল পড়লে এমনিতে বুঝবেন , পানির মইদ্যে চ্যাংয়ের ছঠফটানি যাইব বাইড়া । বোয়াল আইসা চ্যাংরে একেকটা কামড়াইব আর চ্যাংও এদিক-ওদিক লাফাইব । হ্যাঁ , চ্যাংকে ঘায়েল করতে বোয়ালের বোধহয় ভালই সময় লেগে কারন পানিতে একসময় বেশ হুটোপুটির শব্দ শোনা যায় । নিস্তব্ধ করতোয়ার পাড়ে শব্দটা ঠিক যেন বর্শার ফলার মতই বেঁধে কানে । রজব বলেন , চলেন একটা বুঝি পড়ল । আমি আর রজব তড়িঘড়ি করে যাই শব্দটার উৎসটার কাছে ।

গিয়ে দেখি কঞ্চিটা ঠিকই চরের বালিতে গাড়া আছে , বরশীও ঠিক আছে কিন্তু বরশীতে গাঁথা মাছটা আর নেই । আমি রজবকে আমার বামে একটু দূরে পানিতে রূপালী রংয়ের একটা চোখ দেখাই । রজব বলেন , ওঠেন , তাড়াতাড়ি টর্চটা ফেলেন ঐদিকে । আমি আমার সাথে থাকা এক ব্যাটারীর টর্চের আলো নদীর পানিতে ফেলি । পনির মধ্যে রূপালী চোখ নিয়ে একটা বোয়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে । রজব অনেকক্ষন কেশে নেন তারপর বলেন , এই বোয়ালটা অনেক বড় , গতবার পাইছিলাম এইরকম একটা। সচরাচর এইরকম বড় বোয়াল পাওয়া যায় না । আমি বলি কোথায় আমার কাছে তো খুব একটা বড় মনে হল না । রজব বলেন আপনারা সাহেব-সুবা শহরের মানুষ , পানির উপরে থাইকা কি আর বোয়ালরে বুঝতে পারবেন । এতবড় একটা বোয়াল হাতছাড়া হওয়ায় রজবের মন একটু খারাপই হওয়ার কথা কিন্তু তাকে দেখে সেরকম মনে হল না । তিনি বলে চললেন , বুঝলেন যত বড় মাছ তত চালাক । চালাক না হইলে কি আর পানির এত শত্রুর মইদ্যে বাইড়া ওঠন সম্ভব । দেখলেন না চ্যাংটারে কেমনে খাইয়া গেছে । বরশী তো আমরা দিছিলাম চ্যাংয়ের পেটের মইদ্যে । এইটা কামুড় দিছে ল্যাজে । যাই হোক একবার যহন খাইছে তখন এইটা এহানেই থাকব । আসেন আমরা আরেকটা চ্যাং দেই । রজব আগের মতই পলিথিনের প্যাকেটটা থেকে আরেকটা চ্যাং এনে বরশীতে গেঁথে দেন । আমরা চালার সামনে গিয়ে আবার বসে পড়ি ।

খনিকক্ষণ পর আবার হুটোপুটির শব্দ শুরু হয় পানিতে । আগের জায়গাটা থেকেই শব্দটা আসছে । আমরা আবার প্রবল আগ্রহ নিয়ে কঞ্চিটার কাছে যাই ও হতাশ হই । চ্যাংটা নেই । হয়ত আগের বোয়ালটাই মাছটা খেয়ে গেছে অথবা নতুন কোন বোয়াল এসেছিল । বজব আমাকে বলেন , বুঝলেন আগের বোয়ালটাই চ্যাং টা খাইয়া গ্যাছে । এত জলদি জলদি আরেকটা পড়নের কথা না । রজব আরেকটা মাছ বরশীতে গেঁথে দেন এবং আগের মতই আমরা আবার চালার সামনে এসে বসি । আবার কিছুক্ষণ পর বরশীতে বোয়াল পাওয়ার শব্দ পাই কিন্তু কোন বোয়াল আর পাওয়া যায় না । রজবের এই একটা বরশীতেই আরো দুটা চ্যাং নষ্ট হয় , একটাতেও পড়ে না বোয়াল । রজব বিড়বিড় করে কি যেন বলেন । হয়ত মেজাজ খারাপ হয়েছে তার । আমার বেশ মজাই লাগে । আগেই বলেছি মাছ ধরার কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এই রাতে করোতোয়ার পাড়ে আমি আসি নি এসেছি জ্যোসনা রাতে বোয়ালের রূপালী চোখ দেখতে । সে আশা আমার প্রথমবারেই পূর্ণ হয়েছে । সে এক দৃশ্য বটে ! বন্ধুটা আমার ঠিকই বলেছিল । গোটা দুনিয়ায় এরকম সুন্দর দৃশ্য খুব একটা নেই ।

রজব বলেন বুঝলেন তো এইভাবে হইব না , পঁচা লাগব । রজব লোকটার এই এক মুদ্রাদোষ কথায় কথায় বলেন বুঝলেন । পঁচা জিনিসটা কি আমার মাথায় ঢোকে না । আমি বলি পঁচা কি ? রজব বলেন , পঁচাই হইল আসল ধৈর্য্যের খেলা । আসেন আপনেরে দেখাই । রজব চালাঘর থেকে আরেকটা প্লাষ্টিকের প্যাকেট খোলেন । প্যাকেটের ভিতরে বেশ কটু গন্ধযুক্ত রোদে শুকানো পুঁটি মাছ । মাছগুলোর ভিতরের পুরে কাঁটাই বেশ দক্ষতার সাথে তুলে ফেলা হয়েছে । রজব একটা মাছ নিয়ে কাঁটার ফাঁকা জায়গাটায় একটা বরশী বিঁধে দেন । যে জায়গাটায় বোয়ালটা বারবার চ্যাং মাছগুলো খেয়ে যাচ্ছিল তার পাশেই নদীর পানিতে সামান্য দূরে বরশীটা ছুড়ে দিয়ে চরের মাটিতে বসে পড়েন । আমাকে বলেন , বসেন । এইবার হইল গিয়া আসল খেলা । পঁচাটা দিলাম পানির মইদ্যে , এহন বইসা থাকনের পালা । ফকফকা জোসনারা রাইত , খালি বইসা তাকবেন আর খিয়াল করবেন বরশীটার দিকে । পঁচার পুঁটিটা যখন বোয়ালে খাইব তখন বরশীর সূতাটা সইরা যাইতে থাকব একদিকে । বাস , যেইদিকে সূতাটা সইরা যাইব তার উল্টাদিকে দিবেন জোরসে একটা টান । বোয়ালের গলায় আটকাইয়া যাইব কাঁটাটা ।

রজবের কথায় আমি আশ্চর্য না হয়ে পারি না । এত মনযোগ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কিভাবে পঁচার দিকে তাকিয়ে থাকা সম্ভব? রজব আবার বলেন , এইজন্যি তো আপনেরে বারেবারে কই বড়ই ধৈর্য্যের কাম এইটা । এইযে বসছেন একবার পঁচা দিয়া , সারারাত বইসা থাকলেও যে মাছের নাগাল পাবেন তার কি কোন ঠিক আছে ? রজব বসে থাকেন । বসে থাকতে থাকতে পা লেগে গেলে একসময় আমাকে পঁচাটা দেন । ধরেন , এট্টু তামুক খাইয়া আহি । আমি পঁচাটা ধরে বসে থাকি আর মাছের চোখ দেখার জন্য এদিক-ওদিক তাকাই । কিছুক্ষণ পরেই রজব আবার ফিরে এসে আবার পঁচাটা ধরেন । আমি নদীর ধারে এদিক-ওদিক হাটি , সিগারেট খাই , চালাঘরে শুয়ে থাকি । মাছ আর পঁচায় পড়ে না । দু-একবার রজবের কাছে যাই এখানেও নাকি বোয়াল টোপ খেয়ে যাচ্ছে । রজব বলেন , বুঝলেন বড়ই কাউটা মাছরে ভাই এইটা , ক্যামনে ক্যামনে জানি পঁচা খাইয়া যাইতাছে । আমি বলি কিভাবে বুঝলেন এটা আগের বোয়ালটাই , অন্য বোয়ালও তো হতে পারে । রজব খানিকটা ক্ষেপে যান । বিশ বছর ধইরা মাছ ধরতেছি । মাছেরে ভালই চিনি । তয় এরে ছাড়তেছি না আজকে । আপনে যান চালায় শুইয়া পড়েন ।

আমি চালাঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি । মশারীর ফাঁক দিয়ে চরের হাল্কা ঠান্ডা বাতাস ভেঙে ভেঙে ঘরটার মধ্যে ঢুকে পড়ে । ঘুমানোর জন্য আদর্শ আবহাওয়া । ঘুমানোর ইচ্ছা না থাকলেও তাই একসময় ঘুমিয়েই পড়ি ।

ঘুম ভাঙে প্রায় শেষ রাতের দিকে , রজবের গজগজানিতে । বুঝলেন এতদিন ধইরা মাছ ধরি এইরকম চালাক মাছ আর দেখিনি । চ্যাং-পঁচা কিছুই মানতেছে না । চলেন এইবার শেষ চেষ্টাটা করি , কাটাটা মারি । চালাঘরে আমি যেখানে শুয়েছিলাম তার নিচ থেকে পাতলা লোহার তৈরী শাবল জাতীয় একটা জিনিস বের করেন রজব । জিনিসটার মাথায় শাবলের মতই তীক্ষ্ণ ফলা । এটাই নাকি কাটা । রজব পলিথিনের ব্যাগ থেকে শেষ চ্যাংটা বের করেন । আগের মতই চ্যাং টা বরশীতে গেঁথে বরশীর সূতা কঞ্চিতে বেঁধে আগের জায়গাটাতেই পুতে ফেলেন । রজব বলেন , বুঝলেন শ্যাষবারের খেলা এইবার । বোয়ালের চ্যাং টারে ধরার আওয়াজ পাইলেই টর্চ মারবেন ঐ জায়গায় । এরপরে আমি আছি । আমরা আবার চরের মাটিতে বসে জলের শব্দ শুনতে থাকি । অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও যখন কোন বোয়াল আসে না তখন আমার মেজাজ সত্যিই খারাপ হতে থাকে , মাছ ধরাতো আমার কাজ নয় ! আমি রজবকে বলি চলেন আজকে আর মনে হয় হবে না । ঐ বোয়ালটাই যে আসবে তার কি গ্যারান্টি ? রজব আমার কথার কোন জবাব দেন না । মনে হয় বিরক্ত হয়েছেন আমার ওপর । তবে মাছটার উপর তার ক্ষোভ কোন পর্যায়ে এসে পড়েছে তা বুঝতে পারি । আমি এবার রজবের সামনেই একটা সিগারেট ধরিয়ে বসে পড়ি । রজব বলেন সারারাইত তো থাকলেনই , এই শ্যাষবার একটু দেহেন ।

রজবের কথা মিথ্যা হয় নি । ফজরের আজানের ঠিক একটু আগে পানিতে চ্যাংয়ের লাফালাফি প্রবল হয়ে ওঠে । বোয়ালের রূপালী চোখটা আবার আমি দেখতে পাই । রজব মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বলেন আর ইশারায় আলো ফেলতে বলেন । আমি পানিতে মাছটার উপর আলো ফেলি । আলো ফেলামাত্র রজব কাটাটা নিয়ে বিদুৎবেগে মাছটার শরীরে বিদ্ধ করার জন্য পানিতে লাফ দেন । বয়স্ক একজন লোক কিভাবে এত তাড়াতাড়ি কাটাটা সমেত পানিতে লাফিয়ে পড়ে কাটাটা মাছের গায়ে বিদ্ধ করার চেষ্টা করেন তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন । হয়ত টর্চের আলোয় মাছ দূরে সরে যেতে চায় । এত তাড়াতাড়ি না করলে চলবে কিভাবে ? রজবের শেষ চেষ্টাটা বিফলে যায় নি । বেশ বড় সাইজের কাটাবিদ্ধ একটা বোয়াল নিয়ে রজব উঠে আসেন পানি থেকে । কাটাটা দেখি বোয়ালের শরীরের ঠিক মাছখানে বিঁধেছে । থেতলে গেছে বেশ খানিকটা অংশ । রজবের মুখে বিজয়ীর হাসি । কইছিলাম না আগের বোয়ালটাই , দেখছেন কত্ত বড় । আগের বছরে যেইটা পাইছিলাম টার চাইতে এটা বড় । বুঝলেন এইজন্যি কাটা দিয়া মাছ ধরি না , মাছের শইল বলতে কিছু থাকে না । আমি মাছটার দিকে তাকিয়ে থাকি । জলের মধ্যে জীবন্ত মাছের চোখ আর জলের বাহিরে মৃত মাছের চোখের মধ্যে কত পার্থক্য । রজব বলেন আপনেরে কিন্তু আজকে আর সহজে ছাড়তেছি না । সকালে বাড়িত থাইকা মাছের পেটি দিয়া ভাত খাইয়া যাবেন ।

আমি কিছু বলি না । এরকম লড়াকু , পরাজিত আর অবশেষে মৃত বোয়ালটা দেখতে আমার কেন জানি ভাল লাগে না । বাকিটুকু পড়ুন...

আংটি কাহিনী

বাবা-মা ধরনের মানুষগুলো যে খুব একটা কথা রাখে না এটা বুঝতে জাবেরের খুব বেশী দিন সময় লাগে নি । এই যেমন ক্লাস সেভেনে দুইবার একই ক্লাসে থাকার বিষয়টা । অনেকেই সরকারী বৃত্তি পাওয়ার জন্য পন্চম শ্রেনীতে দুইবছর থাকে । তাকে কেন এটা সপ্তম শ্রেনীতে এসে করতে হবে তা প্রথমদিকে তার মাথাতেই ঢোকেনি । বাবাকে জাবের বরাবরই ভয় পায় । নিরূপায় হয়ে মাকেই জিজ্ঞাসা করেছিল ব্যাপারটা । মা বলেছিলেন তার বয়স নাকি কম । অল্প বয়সে স্কুলে দেয়া হয়েছে । আর একটা বছর এই ক্লাসে থাকুক কিছুটা বয়সের পরিপূর্ণতা আসবে । জাবের শুরুতে কিছুটা গাইগুই করেছিল যদিও সে জানত তাকে এই ক্লাসে আরেকবার থাকতেই হবে কারন বাবার সিদ্ধান্তের বাহিরে বাড়িতে কোন কাজ হয় না । জাবের তাই একই বই আরেকবার পড়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল । মা হয়ত জাবেরের গাইগুই করার ব্যাপারটা বাবার কানে তুলেছিলেন । বাবা তাই একদিন জাবেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন জাবের যে এই ব্যাপারটা খুব সহজেই মেনে নিয়েছে এতে তিনি খুব খুশি হয়েছেন এবং জাবেরকে কিছু একটা উপহার দিতে চান সে উপহার হিসেবে কি পেতে চায় । জাবেরের ঐ বয়সে আসলে একজোড়া চাকাওয়ালা জুতা ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার ছিল না । এই চাকাওয়ালা জুতার নামই বা কি তা সে জানত না ।পাশের বাসার কলেজ পড়ুয়া এনাম ভাইকে সে দেখেছে কলোনির পীচঢালা রাস্তায় চাকাওয়ালা একজোড়া জুতা পড়ে সাইকেলের মত জোরে বিকেলে ঘুরে বেড়ায় । তারও এরকম একজোড়া চাকাওয়ালা জুতার খুব শখ , এনাম ভাইয়ের সাথে সে ও ঘুরে বেড়াবে , চক্কর দেবে পুরে কলোনী । বাবা শুনলে রেগে যাবেন এই ভয়ে সে কখনো কথাটা বলে নি । আজ যখন একটা সুযোগ এসেছে তখন সে বাবার কাছে এটার কথাই একবার বলে দেখল । বাবা মাথাও নেড়েছিলেন , দেবেন । জাবেরের এরকম একজোড়া জুতা পাওয়া হয়নি । তার বদলে সে যা পেয়েছে তা সে কখনোই মনে মনে আশা করে নি , একটা বিশ্রী চারকোনা জাপানি কেসিও ঘড়ি । উপহার হিসেবে ঘড়ি দেওয়ার কি আছে ? বাসার ড্রইং রুমেই তো একটা ঢাউস সাইজের দেয়াল ঘড়ি টাঙানো আছে । সময় দেখার জন্য হাতঘড়ির কি দরকার ? দেয়াল ঘড়ি থেকে দেখে নিলেই তো সে পারে । বাবা বলেছিলেন চাকাওয়ালা জুতোগুলোয় চলা নাকি খুব কঠিন , শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে । বললেই হল । জাবেরের খুব মন খারাপ হয়েছিল ।

অষ্টম শ্রেনীতে তাই বাবা যখন বললেন বৃত্তি পেলে একটা সাইকেল কিনে দেবেন জাবের তখন কথাটায় খুব একটা বিশ্বাস রাখতে পারে নি । তবুও তার মনে যে একটা ক্ষীণ আশা ছিল না তা নয় । ছাত্র হিসেবে সে খুব একটা খারাপ না হলেও অন্তত জেলা শহর থেকে বৃত্তি পাওয়ার মত একজন নয় । বৃত্তিটা পেলে সেটা তার কাছে একটা অনাকাঙ্খিত বিষয় তো হবেই বাবা মা ও নিশ্চই খুশিই হবেন । তখন একটা সামান্য সাইকেল দেওয়া তাদের জন্য এমন বিচিত্র কিছু হবে না । জাবেরর মনে এতটুকু ক্ষীণ আশা ছিলই তাই সে বছরের প্রথম থেকে পড়াশুনায় বেশ মনোযোগ দিয়েছিল ।

সে বছর জাবের সরকারী বৃত্তিটা পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার আশাটা আর পূর্ণ হয় নি । সাইকেল নিয়ে প্রাইভেটে ব্যাচে যাওয়ার , এই একটু বিকেল বেলায় নদীর ধারের রাস্তাটা দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সাধটা তার অচিরেই মারা পড়ল । সাইকেল নিয়ে শহরের ব্যস্ত গাড়িঘোড়ার রাস্তায় চলতে সমস্যা হবে , পড়াশুনা কমিয়ে সারাদিন পইপই করে ঘুরবে এরকম নানান অজুহাত দেখিয়ে বাবা মা আর সাইকেলের রাস্তায় গেলেন না । সাইকেলের বদলে একটা সোনার চেইন কিনে দিলেন জাবেরকে । সোনার চেইনটা নিয়ে জাবের এক মহা সমস্যায় পড়ল । একে তো সে পুরুষমানুষ আর পুরুষমানুষের সোনাই যেখানে পরা ধর্মমতে ঠিক নয় তখন এই অল্প বয়সেই কেন তাকে এরকম একটা চেইন পড়তে দেয়া হল এটার কোন কূল-কিনারা করতে সে করতে পারল না । তারপরেও সোনার এই চেইনটা পড়তে সে রাজী ছিল , রাস্তাঘাটে সে দু-একজনকে এরকম চেইন পরে ঘুরতে দেখেছে কিন্তু বিপত্তি বাধাল চেইনের সাইজটা । চেইনটা এত বড় যে বলতে গেলে তার নাভি পর্যন্ত চলে আসে । বাবা মা দিয়েছেন কি আর করা যাবে চেইনটা সে তাই দু-চারদিন পরল । কিন্তু বন্ধুদের যন্ত্রনা যখন চরমে পৌছাল তখন মাকে চেইনটা দেওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় রইল না । মা ও চেইনটা কোন কথা ছাড়া নিয়ে নিলেন । কে জানে হয়ত নিজের জন্যই কিনেছিলেন ! জাবের এটাই ভাবল আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল বাবা মার কোন প্রতিশ্রূতির আশা করা যাবে না । সান্ত্বনার একটা উপলক্ষ্য অবশ্য সে কয়েকদিন পরেই পেয়েছিল । নীল পাথর বসানো সোনার একটা আংটি দেওয়া হল এবার তাকে । অফিস থেকে ফিরে কলার থোড়ের মত লাল একটা বাকসের ভিতর থেকে আংটিটা বের করেছিলেন বাবা। আংটিটা পেয়ে জাবের একটু অবাকই হল । আংটির পাথর সাধারণত হাল্কা নীল বা খয়েরী বর্ণের হয় । তারটা গাঢ় নীল বর্ণের কেন এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারল না । অবশ্য এই আংটিটার জন্য যে তাকে সামনের জীবনে খানিকটা ঝামেলা পোহাতে হবে তা তখনও সে জানত না ।

জাবের আংটিটা অনামিকাতেই পড়েছিল । অবশ্য কেউ তাকে সে সময় বলে দেয় নি অনামিকায় আংটি পরার একটা অন্য অর্থ আছে । ছোট বলেই হয়ত কেউ বলেনি । তবে যে সময় সে প্রথম কথাটা শোনে সে সময় সবেমাত্র তার সর্বনাশ হতে শুরু হয়েছে এবং এটা থেকে পরিত্রানটা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে ।

কলেজে পড়ার সময়ই জাবের বাবাকে হারায় । পরের কয়েকটা বছর তাই সে খুব একটা সুবিধার মধ্যে পার করতে পারে না । বাবার সামান্য পেনশনের টাকায় নিজের , ছোট ভাইদের পড়াশুনা আর পরিবারকে চালিয়ে নিতে তাকে হাপিয়ে উঠতে হয়,ধরতে হয় টিউশনি । এসময় একেকটা দিন যেন একেকটা বছর মনে হতে থাকে তার কাছে । অবশ্য এ অবস্থায় তাকে বেশীদিন কাটাতে হয়নি । গ্রামের বাড়িতে নদীর মধ্যে থাকা জমিগুলো চর হয়ে জেগে ওঠাতেই যা রক্ষে । ওসব আধিয়ারদের দিয়ে যা টাকা-পয়সা পাওয়া যায় তাতে ওদের ভালই চলতে শুরু করে । ক্রান্তিকালের ঐ কয়েকটা বছরে তাকে দেখে হয়ত সবাই খানিকটা সহানুভূতিতে ভুগত , তাই হয়ত অনামিকার আংটিটার দিকে কেউ নজর কেউ কখনও দেই নি ।

অনামিকার আংটিটার দিকে যাদের নজর দেয়ার কথা ছিল তারাই অবশ্য প্রথম নজর দেয় , বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা । কিসের জন্য আংটি পরেছিস ? বিয়ে করেছিস ? এগেজড ? নাইলে কে দিল ? নানান প্রশ্ন । প্রথমদিকে অবশ্য সবাইকে সে খানিকটা সময় নিয়ে আংটির বিষয়টা বলত পরে হাল ছেড়ে দিয়েছে । হেসে বলে হ্যাঁ বিয়ে করেছি বা বিয়ে হবে হবে করছে । যদিও বিয়ে করা বা বিয়ে হবে হবে করা থেকে সে অনেকটা দূরেই ছিল সবসময় । আংটিটার জন্যই কিনা কে জানে মেয়েরা তার সাথে কখনো ভালভাবে মেশে নি !

একবার সে অবশ্য আংটিটা খোলার কথাও ভেবেছিল কিন্তু প্রায়াত বাবার শেষ স্মৃতির কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত খুলতে পারে নি । তবে অনামিকায় থাকাতেই যখন সমস্যা তখন এটাকে অনামিকা থেকে খুলে মধ্যমা বা অন্যকোন আঙুলে পরার কথাও সে একবার ভেবেছিল । শেষ পর্যন্ত এটাও হয়নি । সাত-আট বছর আগে পরা আংটি । এতদিনে তার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আঙুলের বয়সও বেড়েছে , বেশ মোটাই হয়েছে আঙুল । অন্য আঙুলে পরা তো দূরের কথা সাবান দিয়ে ঘঁষেও অনামিকা থেকে আংটিটা খুলতে পারেনি । অবশেষে সে হাল ছেড়ে দিয়েছে , মনস্ত করেছে থাকুক অনামিকাতেই থাকুক বাবার স্মৃতিটা । বিয়ে করলে দরকার হলে বিয়ের আংটিটা অন্য আঙুলেই পরবে । আংটিটার যত্নেরও সে কোন ত্রুটি করে নি । দীর্ঘদিন ব্যবহারে আংটির গাঢ় নীল পাথরটা খনিকটা বিবর্ণ হয়ে গেলে সে এটাকে পাল্টিয়ে গাঢ় নীলের একটা পাথর বসিয়ে নিয়েছে ।

এমনিতেই আংটিটা নিয়ে জাবেরের কোন সমস্যা ছিল না , দুই একজন মজা করে বিয়েসাদি নিয়ে এটাওটা বলে তো বলুক সমস্যা নেই কিন্তু জাবেরের অন্য একটা কাজে আংটিটা বাধা হয়ে দাড়াল । বিয়ে করার জন্য জাবেরের একটা মেয়ের সাথে খনিকটা পরিচিত হওয়া বা আরও ব্যাপকভাবে বলতে গেলে প্রেম করা খুব দরকার হয়ে পড়েছিল । জাবেরের বাবা মা সেই কোন দশকের রক্ষনশীল সমাজে প্রেম করে বিয়ে করেছিল । তাই এই দশকের ছেলে হিসেবে তারও প্রেম করে বিয়ে করা বা নিদেনপক্ষে কিছুদিন জেনেশুনে একটা মেয়েকে বিয়ে করা প্রায় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে । জাবের এটা বুঝেছে , বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যায়ে এসে এটাও বেশ ভালভাবেই বুঝেছে যে স্বাভাবিকভাবে যেভাবে প্রেম বা ভাবভালবাসা হয় তার এভাবে ওরকম কিছু হবে না , বিশেষত এ পর্যন্ত তার যখন কোন বান্ধবি পর্যন্ত কেউ একজন নেই ।

অগত্যা নিরূপায় তরুনের শেষ পথ হিসেবে সে ইন্টারনেটকেই বেছে নিয়েছে । আর কে না জানে এসব পথে জাবেরের মত তরুনদের জন্য মেয়েদের অভাব কখনো হয় নি । জাবেরেরও অবশ্য খুব একটা সময় লাগেনি । কিছুদিন একজনের সাথে ভাল ঘনিষ্টতার পর একজন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আজকালের ছেলেদের মত সে কানে সোনার দুলটুল পরে কি না ? জাবের নির্দোষ জবাব দিয়েছিল সেটা সে পরে না তবে সোনা যে একেবারে পরে না তা নয় একটা আংটি পরে । মেয়েটা জানতে চেয়েছিল কোন আঙুলে সে আংটিটা পরে । জাবের হুট হাট মিথ্যা বলতে পারে না অথবা সে ভেবেছিল আঙুলের কথাটা বলুক পরে কারনটা বলবে । কিন্তু মেয়েটা অনামিকার কথাটা শোনার পর আর বেশী দেরী করে নি । জাবের অবশ্য যোগাযোগের চেষ্টা খনিকটা যে করে নি তা নয় , লাভ হয়নি । জাবের সান্ত্বনা খুঁজেছে । ক বলতে কলিকাতা শোনার অভ্যাস এ দেশের লোকজনের বহু দিনের স্বভাব , খামাখা মেয়েটাকে দোষ দিয়ে কি লাভ ? অবশ্য জাবেরের মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল । পাশ করার পর অফিসে-আদালতে নিশ্চই হবে , কিছু একটা হবে । কিন্তু সে সবে গিয়ে সে দেখেছে কেউ আর তাকে বিয়ের কথাই জিজ্ঞাসা করে না । হয়ত এটা একটা খুবই ব্যক্তিগত একটা প্রশ্ন , জিজ্ঞাসা করতে লোকজনের রুচিতে বাঁধে অথবা সবাই তার অনামিকাতে আংটি দেখে বুঝেছে সে বিবাহিত । কেইবা জানে এই কুফা আংটির ফল তাকে কতদিন বয়ে বেড়াতে হয় ? বাকিটুকু পড়ুন...