যাপিতজীবন -০২ : : জমাট কলা কাহিনী

ছেলেবেলায় আমি কখনও জমাট কলা ( দুইটি কলা একসাথে থাকে ) খাই নি । আরও সহজভাবে বলতে গেলে জমাট কলা কখনও পাইনি যে খাব । আমাদের বাসায় আব্বা কখনও জমাট কলা আনতেন না । বাসায় সবাই জানত কোন পুরুষমানুষ জমাট কলা খেলে তার বৌ এর জমজ বাচ্চা হয় ! এক বাচ্চার দুনিয়ায় আসা আর তার বেড়ে ওঠা নিয়েই যত সমস্যা দুইটা বাচ্চার রিস্ক নেয় কোন বোকা ? তাই বাসায় পাওয়া এ শিক্ষাটা আমি অনেকদিন মেনে চলেছি । পরিচিত অনেক বন্ধু ও মানুষকেই পরবর্তিতে দেখেছি তারাও এ ঝুঁকি নিয়ে জমাট কলা খান না । সুতরাং এই বিষয়টা নিয়ে কোথাও তেমন কোন বিড়ম্বনার মধ্যে আমাকে পড়তে হয়নি , মুখোমুখি হতে হয়নি বন্ধু-বান্ধবের টিটকারীরও ।

জমাট কলা না খেয়ে ,বৌয়ের ডাবল কাচ্চা-বাচ্চার ঝুঁকি এড়িয়ে দিন আমার ভালই যাচ্ছিল কিন্তু বিধাতার বুঝি আর সহ্য হল না । আঠারো বছর বয়সে যখন সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বান্ধবি( পড়ুন প্রেমিকা ) জোটানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন ঐ বয়সে আমার মধ্যে তীব্র বৈরাগ্যবোধ জন্ম নিল । এই অধমের মনে হল এই জীবন আর সংসার সব ঝুটা হ্যায় । কি লাভ এতে ? সিদ্ধান্ত নিলাম সারাটা জীবন অকৃতদারই থেকে যাব (এখন অবশ্য মাথা থেকে ভূতটা নামছে , মনে হচ্ছে বিয়াটা জরুরীই!)। বিয়েই যখন আর করছি না তাই বৌ বা কাচ্চা-বাচ্চা কিছুই আর হচ্ছে না । সুতরাং ডাবল বাচ্চার রিস্ক থাকা সত্ত্বেও জমাট কলা আমার জন্য হালাল হল । কিন্তু অন্য সকল ভাইরা যারা বিয়ে করেছিলেন বা বিয়ে করার মনস্ত করেছিলেন তাদের জন্য এই প্রজাতির কলা তখনও হারাম(!) ছিল । বলা বাহুল্য তার সুফল সেই সময় থেকে আমি পেতে শুরু করেছিলাম এবং এখনও পাচ্ছি । কিভাবে ? সেই হিসাবটাই আমি এখন বলব ।

একবার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার পর হলে খাবার-দাবারের প্রার্দুভাব দেখা দেয় । পর্যাপ্ত ছাত্র নাই এই হেতু প্রায় সব হলের (একটি বাদে ) ক্যান্টিন বন্ধ করে দেয়া হয় । আহার গ্রহনের নিমিত্তে জৈষ্ঠ মাসের তালপাকা দুপুরে দূরবর্তী হলের ক্যান্টিনে নির্দিষ্ট সময়ে যেতে হয় । সময়ের একটু এদিক ওদিক হলেই সারা ! গিয়ে কতগুলো টেবিলে ছাত্রদের চাবানো মুরগীর হাড় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না । সুতরাং সময় নিয়ে সবসময় তৎপর থাকি । কিন্তু বন্ধের মাসে কতই বা আর ঘড়ি ধরে চলা যায় ? দুপুরের প্রবল ঘুমের তোড়ে একবার ক্যান্টিনের টাইম মিস হয়ে যায় । অগত্যা ক্ষুধায় কাতর আমি যাই পলাশী বাজারে রুটি আর কলা কিনতে । তখন দ্রব্যমূল্যর উদ্ধগতিতে প্রতি পিস কলার দাম সবে দুই টাকা থেকে তিন টাকা হয়েছে । এমনিতেই সারা মাস বাহিরে বাহিরে খেয়ে পকেটের অবস্থা টাইট তারপরে দোকানীও দেখি বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান কলা তিন টাকা করে চায় প্রতিটা । মেজাজ অত্যধিক খারাপ । জমাট দুইটা কলা দেখিয়ে দোকানীকে বলি আলাদা দুইটার ঝামেলা না করে ঐ দুইটাই দিন । দোকানীকে দশ টাকার একটা নোট দেই। দোকানী আমাকে সাত টাকা ফেরত দেয় । আমি লোকটার কান্ডজ্ঞান দেখে অবাক হই । এরে দিয়ে ব্যবসা হচ্ছে কিভাবে ? দোকানীকে বলি আমি তো দুইটা নিছি আপনি একটার দাম রাখছেন । দোকানীও মনে হয় আমার কান্ডজ্ঞান দেখে অবাক হয় । বলে জমজ কলার দাম একটার দামের সমান । দোকানীর ভাবটা এমন এই সাধারণ জিনিসটা আমি এতদিন জানতাম না ! আমি যুগপৎ অবাক আর আনন্দিত হই । এই চরম দুর্দিনে একটার দামে দুইটা কলা ( হোকনা জমজ) পাওয়া যাচ্ছে এটা কি কম আনন্দের ! আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ঐ দোকানেই শুধু মনে হয় এই হিসাব কিন্তু পরে অন্য দোকানেও দেখেছি একই অবস্থা । আমি সেই থেকে কলার দোকানে গেলে জমাট কলা খুঁজি । একটা কলার দামে যখন দুটি পাওয়া যাচ্ছে সেখানে আলাদা করে দুটি কিনে দোকানীকে বেশী টাকা দিয়ে কি লাভ ! বাকিটুকু পড়ুন...

যাপিতজীবন -০১ : : পরিচয় সংকট

লোকগুলোর সাথে আমাদের দেখা হয় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার সূরা মসজিদে । তিনজন লোক , সবাই মধ্যবয়স্ক । মসজিদের সামনের বিশাল তেঁতুল গাছের নিচে বসে হয়ত বাতাস খাচ্ছিলেন তারা । আমরা গিয়েছি মসজিদটা দেখতে । অনেক পুরানো ঐতিহাসিক মসজিদ যেটা ঠিক কখন তৈরী হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না । স্থানীয়দের সাথে এ মসজিদটা নিয়ে একটু কথা বলতে ইচ্ছে হল আমাদের । লোকগুলোকে দেখে আমাদের ভালই লাগল যাক বেশ হল আমারাও ওনাদের সাথে তেঁতুল গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেই আর গল্প করি । আমিই প্রথম কথা বলতে শুরু করি তাদের সাথে-আপনারা কি এই গ্রামেরই ।-হ্যাঁ , এখানকারই । ঐ পাশে বাড়ী ।একটা লোক ইশারা করে সবুজ ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ওনাদের বাড়ি দেখিয়ে দেয় আমাদের । আমি একজনের হাতে একটা নাইলনের ব্যাগ দেখি ভিতরের কি জানি কুঁ-কুঁ আওয়াজ করছে । কৌতুহল হয় ভিতরে কি আছে জানার । আমি আবার জিজ্ঞাসা করি-ব্যাগের ভিতরে কি ?লোকগুলোর মধ্যে একটা কেমন যেন অস্বস্থিভাব দেখতে পাই । একজন মৃদুকন্ঠে জবাব দেয়-ইঁদুরবুঝতে বাকি থাকে না লোকগুলো সাঁওতাল আর এরা এগুলো খাওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে । তারপরও জিজ্ঞাসা করি-এগুলো তো খাবেন তাই না ?লোকগুলোর মধ্য অস্বস্থিভাবটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে যদিও আমার জিজ্ঞাসা করার মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা ছিল না ।-হ্যাঁ , খাব । আমরা আদিবাসি ।মুখ শুকনো করে বলে একজন । তাদের মুখ থেকে আমরা তাদের আসল পরিচয়টা পাই কিন্তু পুরোটা পাইনা । তারা হয়ত এটা বুঝতে শিখেছে সাঁওতাল বলার চেয়ে আদিবাসী বলাটা আমাদের মত ভদ্র পোশাক-আশাক পরা লোকের কাছে অনেকটা শোভন । আমি জিনিসটা আরেকটু নাড়াতে চাই- সাঁওতাল তাই না ?-হ্যাঁ ।লোকগুলোর মুখ আরো শুকনো হয়ে ওঠে । একজন আবার বলে এখন সাঁওতাল আর অন্য সমাজের (পড়ুন হিন্দু বা মুসলমান সমাজ) মানুষের মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই , সবাই ক্ষেত-খামারের কাজ করছে একসাথে , আগের মত বন-জঙ্গলও নেই শিকার-টিকারও নেই । আমাদের মত ভদ্রস্থ শার্ট-প্যান্ট পড়ে আসলে নাকি আমরা তাদের চিনতেই পারব না তারা সাঁওতাল আরেকজন বলে । লোকগুলো তাদের গা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাঁওতাল গন্ধ মুছে ফেলতে চায় , যত তাড়াতাড়ি পারে মিশে যেতে চায় সাধারণের মাঝে যাতে তাদের হঠাৎ করে সাঁওতাল বলে তাদের আলাদা করা না যায় । সাঁওতালদের একটা নিজস্ব কৃষ্টি আছে , কালচার আছে । কি এমন কারন যার জন্য একটি সম্প্রদায়কে তাদের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করতে হয় , প্রজন্মকে ভুগতে হয় আত্বপরিচয় বিষয়ক সংকটে ? আমরাও কি এর বাহিরে আছি ? http://www.sachalayatan.com/imrulkayes/16840 বাকিটুকু পড়ুন...

একটি কর্তিত বৃক্ষের জন্য এলিজি

এই লেখাটা একটা গাছকে নিয়ে লেখা , প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলের একটা গাছ যেটাকে বছর চারেক ধরে দেখছি এবং হঠাৎকরে মাত্র ঘন্টা চারেক আগে কেটে ফেলা হবে এমনটা কখনো চিন্তাও করিনি। অনেকদিন ধরে সচলে লিখিনা , টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা , অমানুষিক পড়াশুনার চাপ । মাঝে মাঝে নেটে ঢুকলে সচলেই ঢুকি , অফলাইনেই থেকে পড়ি , লেখা-টেখায় কমেন্ট না করেই চলে যাই - আবার পড়তে বসি । এভাবে ঝাড়া মাসদেড়েক চলার পর পরীক্ষা শেষ হয় । আমিও হাত-পা ঝেড়ে উঠি , সচলে লিখব বলে লেখার প্লট রেডী করি গল্প -কবিতা এইসব আরকি । কয়েকদিন ধরে মাথার মধ্য একটা গল্প ঘোরে , গতকাল রাতে লিখেও ফেলি কয়েকটা প্যারা । বাকীটা লিখব ভেবে আজকে অলস দুপুরে দীর্ঘক্ষণ ঘুমিয়ে বিকেলে ঘুম থেকে থেকে উঠি , চা-টা খেতে যাই পলাসী বাজারে । মাথায় গল্পের প্লট ঘোরে কিন্তু আমি জানি গল্পটা আজকে আর লেখা হয়ে উঠবে না । চারতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতেই আমার মনে হয় চারপাশে কিছু একটা নেই । নিচে নেমে দেখি হলের লোকজন ডালপাতা সরাচ্ছে , অর্ধেক কাটা একটা গাছ মাটি থেকে তিন-চারফুট উচ্চতা নিয়ে কোন ধরনের শাখা-প্রশাখা ছাড়াই দাড়িয়ে আছে । আমার ভাবতে কষ্ট হয় এটা সেই গাছটা যেটা প্রতিনিয়তই দেখছিলাম , যেটা কখনও আলাদা করে নিজের অস্তিত্ব ঘোষনা করেনি , আমরাও বুঝতে পারিনি আলাদাভাবে সে আমাদের সাথে মিশে আছে কিন্তু তার অনস্তিত্ব এখন বেশ বড় করে বাজে , আমি বুঝতে পারি কেউ একজন আশেপাশে ছিল যে আজ নেই , যেন চারপাশটা ফাঁকা করে কেউ একজন চলে গেছে। গেটে একজন কর্মচারী ছিল । আমি তাকে বলি কে কাটল গাছটা । আমার কন্ঠে বোধহয় কিছুটা আলাদা কোন ঝাঁঝ ছিল । সে বুঝতে পারে । উত্তর দেয় প্রভোষ্ট স্যারের নির্দেশক্রমে হলের লোকজন কেটেছে । আমি কাটার কারন জানতে চাই । সে কোন উত্তর দিতে পারে না , শুধু বলে স্যার বলেছে এজন্য লোকজন কাটছে । সে ও ব্যাপারটা মানতে পারে না বলে গাছটা কাটায় পুরো বিল্ডিংটা কেমন জানি ন্যাড়া হয়ে গেছে । আমি তাকে আর কিছু বলিনা , কাটা গাছটার দিকে বোকার মত অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকি । এই দুনিয়ায় অনেক কিছুই হচ্ছে যেগুলো নিয়ে আমি কখনও মাথা ঘামাই নি । চারদিকে কথাবার্তা হয় পরিবেশ দূষন হচ্ছে , গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত , গাছ লাগাতে হবে , পরিবেশ রক্ষা করতে হবে -এইসব কথাবার্তা কখনও আলাদাভাবে দৃষ্টি আকর্ষন করেনি আমার । সুতরাং গাছটা কাটায় পরিবেশের কি ক্ষতি হল ,না না হল তা আমার মাথাব্যথার বিষয় নয় । খুব স্বার্থপর একজন মানুষ হিসেবে আমার শুধু নিজের কথাটাই মনে হচ্ছে , মনে হচ্ছে কেউ একজন আমার খুব কাছে ছিল আজ সে নাই । আমার অভিযোগটা সেই শুন্যতাটা নিয়েই । আগে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে গাছটা দেখতাম এখন আর দেখতে পাব না , আমার অভিযোগ এই শূন্যতাটা নিয়েই । আমি অনেকক্ষন ধরে কাটা গাছটার দিকে চেয়ে থাকি । দু-চার জন ছাত্র হলে ঢোকে , এদেরও চোখে জিনিসটা অস্বাভাবিক লাগে । কেউ কেউ স্বগতোক্তি করে আহ! হঠাৎকরে গাছটা খামাখা কাটল কেন ?শূন্যতা জিনিসটা কারই বা ভাল লাগে ? পরিশেষ: সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোষ্ট মহাশয়কে বলছি , জানি লেখাটা হয়ত কোনভাবেই আপনার নজরে পড়বে না , কিন্তু আমার বলা দরকার সেজন্যই বলছি , হলের বাজেটে সমস্যা হলে প্রতি বছর ছাত্রদের প্রদেয় ফি বিশ টাকা করে বাড়ান কিন্তু হুটহাটএরকম পুরানো কোন গাছ দয়া করে কেটে ফেলবেন না ।(২৯ জুন ২০০৮ রাত নয়টায় লেখা) http://www.sachalayatan.com/guest_writer/16388 বাকিটুকু পড়ুন...