একটি খুনের স্বপ্ন : : অনেকদিন আগে পড়া একটি বই নিয়ে গল্প

সেদিন একজনের সাথে কথা হল । তিনি আমাকে বললেন গল্প -উপন্যাসের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই । সবই নাকি ফ্যান্টাসি লাগে । পড়তে ধরলেই নাকি মনে হয় এসবের কিছুই কখনো বাস্তবে হয় নি , বিশ্বাস করার কোন কারন নেই । গল্প নিছক গল্পই । আর আগ্রহ পান না পড়ার । এসব আর কি ? পরে আমি ওনার কথাগুলো নিয়ে ভাবতে থাকি । আসলেই কি এগুলো ফ্যান্টাসি ? বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে কি অত্যধিক মাত্রায় অনুভূতিপ্রবণও নয় । এরকম ভাবতে পারলে হয়ত সামান্য কিছু লাভ হতে পারত , অন্তত আমার ক্ষেত্রে । কিছু কিছু বই পড়ে যন্ত্রনাও পেতে হয় । যন্ত্রনাটা প্রখর হয়ে ওঠে যখন সেটা সাময়িক মানে দু -এক ঘন্টা না স্থায়ী না হয়ে কয়েকদিনব্যাপি স্থায়ী হয় । আজকে আমি সেরকম একটা বই পড়া বিষয়ক যন্ত্রনার কথাই বলব । আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি । হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে চারিদিকে প্রচুর হইচই হচ্ছে । আমিও এই হইচইয়ে যোগ দেই । নীলক্ষেত থেকে আজাদের যত বই আছে একে একে কিনে পড়ে ফেলতে থাকি । ওনার কবিতাগুলো ভাল লাগতে থাকে , মুগ্ধ পাঠক হয়ে উঠতে থাকি ওনার কবিতার । কিন্তু উপন্যাস যে দু একটা পড়ি (শ্রাবনের বৃষ্টিতে রক্তজবা , ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ ) এগুলোকে একঘেয়ে মনে হয় । কেমন জানি উপমার বাহুল্যতা আর গায়ে পড়ে অশ্লীল কথাবার্তা শোনানোর মত মনে হয় উপন্যাসগুলো । কিছুতেই টানতে পারে না উপন্যাসগুলো । আজাদের উপন্যাস কিনবনা কিনবনা করেও একদিন আরেকটি কিনে ফেলি ," একটি খুনের স্বপ্ন" । একশো বিশ বাইশ পৃষ্ঠার ছোট একটি বই , ভালমত পড়তে তিন -চার ঘন্টার বেশী লাগার কথা না । উপন্যাসের ঘটনা তারচেয়েও সামান্য । সহজভাবে বলতে গেলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের প্রেম কাহিনীর বর্ণনা । কিন্তু আজাদের হাতে এই সামান্য কাহিনীই অসামান্য হতে শুরু করে । প্রেমিকা সুফিয়ার জন্য নায়কের অনূভূতি , তাকে পাওয়ার আকুলতা সর্বোপরি নায়কের স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রেমিকার উপস্থিতি এবং তৎসংলগ্ন প্রভাবের বর্ণনা পড়ে আমি মুগ্ধ হতে থাকি । অনবরত বলতে থাকা উপমাগুলোকে আর অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না । বইয়ের অর্ধেক অংশজুড়ে এই রোমান্টিসিজমের পর ঘটনা একটু অন্যদিকে মোড় নেয়া শুরু করে । স্বাভাবিক পাঠকমাত্রই বুঝতে পারছেন বিচ্ছেদ হবে আরকি ? কিন্তু আজাদ এই বিচ্ছেদের বর্ণনাটা দেন একটু অন্যভাবে । তোফাজ্জল নামক এক কথিত ভাইয়ের সাথে নায়ক পরিচয় করিয়ে দেয় প্রেমিকার । ধীরে ধীরে তোফাজ্জল চর্তুপাশ ঘিরে উঠতে থাকে সুফিয়ার । নায়কের অজান্তে যায় সুফিয়ার বাসায় , নানান ধরনের উপহার দিতে থাকে সময়ে অসময়ে । তোফাজ্জল আর সুফিয়ার মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে আরেকটি সম্পর্ক । নায়কের বুঝতে প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও একদিন সে সরাসরি বুঝতে পারে । বুঝতে পারে একদিন সকালে তোফাজ্জলের বাসায় । আজাদের বর্ণনা অনুযায়ী উদ্ধৃতি আমি নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে প্রথমে অন্ধ হয়ে যাই , তারপর আমার চোখে আলো জ্বলে ওঠে , অন্ধকার থেকেও যা উজ্জ্বল , মহাবিশ্ব ভেঙে পড়ার পর দেখা যাবে যে -আলো ,আমি তাদের কাছে এগিয়ে যাই ; বিকট সিল মাছের মত কালো নগ্ন তোফাজ্জল ভাইয়ের আবর্জনাস্তূপের মতো দেহের ওপর একটি পা রেখে নগ্ন সুফিয়া ঘুমিয়ে আছে , সিলটি পড়ে আছে লাশের মত সুফিয়ার মুখটি পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলছে , সরস্বতী ও অসুর জড়িয়ে আছে একে অন্যকে , দুজনেই গভীর ঘুমে নিমজ্জিত , হয়ত একাধিক সঙ্গমের তারা ক্লান্ত সুখনিদ্রায় লুপ্ত হয়ে আছে , জেগে উঠে আবার সঙ্গম করবে পশু ও সুন্দরী । এরপর নায়ক একটি খুনের স্বপ্ন দেখা শুরু করে , যা সে দেখতে পায় স্বপ্নে । প্রথমে সে বিব্রত বোধ করা শুরু করে ভয়ও পায় খানিকটা কিন্তু পরে সে এটাকে একটা অর্পিত দায়িত্ব ভাবা শুরু করে যেন অবশ্যই পালন করতে হবে । নায়কের মাথায় একটি স্বপ্ন জেগে থাকে - একটি খুনের স্বপ্ন । আমি উপন্যাসটি পড়া শেষ করি । আমার প্রচন্ড আক্রোশ তৈরী হতে শুরু করে তোফাজ্জলের উপর , সুফিয়ার উপর। কিছুই ভাল লাগে না । আমি বারবার নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি আরে এটাতো সামান্য একটা উপন্যাসই , লেখকের মনে হয়েছে লেখক লিখেছে । কিন্তু সান্ত্বনায় কোন কাজ হয়না । আমি বারবার ভুলে যেতে থাকি এটা একটা উপন্যাস । আমার মনে হতে থাকে নায়কের চরিত্রে আমি দাড়িয়ে আছি । নগ্ন সুফিয়া সামগ্রিক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য নিয়ে বাহুবন্ধনে পড়ে আছে তোফাজ্জলের । আমার রাগ বাড়তে থাকে । রাগ বাড়তে থাকে তোফাজ্জলের উপর , রাগ বাড়তে থাকে সুফিয়ার উপরও । আমি পলাশী বাজারে যাই , চা খাই । সেসময় সিগারেট খেতাম না কিন্তু সিগারেটও ধরাই একটা । একটা যন্ত্রনা আমার মাথার মধ্যে কাজ করে । আমি যন্ত্রনাটাকে সরাতে চেষ্টা করি কিন্তু এটা মাথার মধ্যে গেড়ে থাকে আরো দু তিনদিন । অজান্তে আমিও একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি , নিতান্ত ছেলেমানুষি স্বপ্ন - একটি খুনের স্বপ্ন ।(এটা লেখাটা নিতান্ত মাত্রাতিরিক্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয় , পাঠকদের বলে নিলাম । বই পড়ার মধ্যে যে একটা যন্ত্রনা আছে সেটা সেই কয়েকদিন বুঝেছিলাম ) http://www.sachalayatan.com/guest_writer/15439