কুয়াকাটা-০২

[১] কুয়াকাটায় কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিনের মত এত ওয়েভ নাই যে ঢেউয়ের তালে তালে নাচা যাবে । আমরা ছয়জন তাই কোমড় পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে খোশগল্প করছিলাম । অধিকাংশই বয়সের দোষে কুশীল আলাপ । এমন সময়ই ভদ্রলোকটির সাথে আমাদের দেখা । সমুদ্রের পানিতে সাঁতরাচ্ছেন আর আমাদের কি জানি বলছেন । কথা ভালমত বোঝাও যাচ্ছে না । শুধু একটাই বুঝলাম হোয়ার ফ্রম ইউ ? আমরা বললাম উই আর ফ্রম ঢ্যাকা । ইউ । তিনি বললেন আই অ্যাম ফ্রম সাইপ্রাস,হ্যাভ ইউ হারড দা নেইম সাইপ্রাস ? সাইপ্রাসে উচ্চশিক্ষার ফেরী করে বেড়াচ্ছে ঢাকার নানান এজেন্সী । পত্রিকা খুললেই বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে "হায়ার ষ্টাডিস ইন সাইপ্রাস "। পড়াশুনা জাননেওয়ালা লোকের তাই সাইপ্রাস শব্দটা না শুনে উপায় নাই । আমরা তাই বলি ইয়েস উই হ্যাভ । মিশ্রিপাড়ায় গৌতমের মূর্তিমিশ্রিপাড়ায় গৌতমের মূর্তিভদ্রলোক এবার আমাদের কাছে আসেন । নানান আলাপ জুড়ে দেন । অধিকাংশই সাইপ্রাসের আলাপ ,ভূমধ্যসাগরের আলাপ । সাইপ্রাস ইজ এ ভেরী নাইস কান্ট্রি নট ক্রাউডেট লাইক দিস কান্ট্রি । এইসব আলাপ আর কি ? আমাদের মেজাজ খারাপ হয় । শালা সাইপ্রাসের গুন গাইতাছস গা , বাংলাদেরশের নিন্দা করছ কির লাইগা ? কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেন আর ইউ স্টুডেন্টস ? আমরা বলি ইয়েস। ফ্রম হয়ার? আমাদের একজন বলে বুয়েট। সে আরও বলে হ্যাভ ইউ হার্ড দিস বিফোর , দিস ইজ বাংলাদেশ ইউনিভারসিটি অব ইন্জিনিয়ারিং টেকনোলজী । ও ইয়া আই হ্যাভ হার্ড দিস ,ইট ইজ বিসাইড ডিএমডিএইচ(ডিএমসি বোঝাইতে চেয়েছে বোধহয়)। আমরা খুশি হই । যাক অন্তত একজন বিদেশীর দেখা পাওয়া গেল যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে চেনে । বিদেশে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালের যে ভাবমূর্তি ! সেদিন চার হাজার টপ লিষ্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা তালিকা দেখলাম । বাংলাদেশের শুধু একটাই বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেখানে । বুয়েট । সেটাও তিন হাজারের পর পরে । প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও কোন অস্তিত্ব নাই চার হাজারের মধ্যে ।যাই হোক ভদ্রলোকের সাথে কথা জমে উঠেছে । কথা জমবেই না কেন ? বিদেশ সম্বন্ধে আমাদের অসীম আগ্রহ আর প্রশ্ন । আমরা নানান প্রশ্ন করছি , তিনি উত্তর দিচ্ছেন আর আমরা ,আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে আমি বিশেষ লাইনে আলাপ জমানোর ধান্ধা করছি। বিশেষ লাইনটা কি নিশ্চয় আর বলে দিতে হবে না । এমন সময় ভদ্রলোক (না ভদ্রযুবক ,ইনার বয়স ত্রিশের মত হবে) আসল কথাটি পাড়লেন অ্যাকচুয়ালী আই অ্যাম এ বাংলাদেশী , লিভিং সাইপ্রাস সিন্স টু থাউজেন্ট ত্রি । নাউ ইন বাংলাদেশ ফর পাইভ অর সিকস মান্থস। আমরা মনে মনে ভাবি ও আচ্ছা ,এইজন্যই তুমি বাংলাদেশের নিন্দা কর এরপর তিনি পরিস্কার কুমিল্লার বাংলা বলা শুরু করলেন । ইনার উপর মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায় । অযথা ইংরাজী কওয়ার কি দরকার । আমরা কি বাংলা বুঝি না ? নাড়িভূরি নিংড়ে ইংরেজী কইতে কি সমস্যাই না হল এতক্ষন । এখন তো ভালই বাংলা বলছেন ।

সন্ধ্যায় এই লোকের সাথে বার দেখা হয় । বীচে সবাই মিলে ছাতার নিচে আর আরামকেদারায় শুয়ে গল্প করতে থাকি । একসময় ভদ্রলোকের সাথে সম্পর্কটা মাইডিয়ার টাইপ হয়ে ওঠে । কথা শুরু হয় মদ আর মেয়ে নিয়ে । আমরা জিগাই কি গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি ? তিনি বলেন হ্যাঁ । সাইপ্রাসের মেয়ে । ওরে ! কত শুটকি রে ।ওরে ! কত শুটকি রে । অতি উৎসাহী হয়ে তিনি তার গার্লফ্রেন্ডের একটা ভিডিও দেখান আমাদের । আমরা বলি ভালই তো । এরপর উনি আরও নানান জাতের মেয়েদের গল্প আমাদের শোনান । টার্কির মেয়েদের গল্প, পূর্ব ইউরোপের পিছনে ছিলমারা মেয়েদের গল্প কি নেই এতে । আমরা অবাক হই ,যারা অবাক হয় না (হয়ত দেশেই অনেক মেয়েদের সাথে দুএকজনের এটা-ওটা আছে!) তারা অবাক হওয়ার ভান করে । আহা! কি আরামেই না ইনারা আছেন । ভদ্রলোক এবার মদের আলাপ শুরু করেন। কতইনা মদের নাম আর কতইনা তার বাহার । আমাদের গলা শুকিয়ে ওঠার জোগার হয় । তিনি আমাদের কাছে জানতে চান কি বিয়ার-টিয়ার চলে নাকি ? আমরা গাঁইগুই করতে থাকি । হ্যাঁ , না , মানে চলে হালকা পাতলা । আমাদের মনে ক্ষীন আশা জাগ্রত হয় । সামান্য বিয়ার বুঝি আজকে গলায় শুটকি না দানবশুটকি না দানব জোটেই । আমরা আরো গল্প জাকিয়ে তোলার চেষ্টা করি । কিন্তু চাইলেই তো আর সব হয় না । আমাদের বিয়ার খাওয়ার আশায় গুড়োবালি দিয়ে এবং ছাতা-আরামকেদারার সামান্যটুকু বিল না দিয়েই তিনি কেটে পড়েন । তাকে নিয়ে বাকি সময়টা কুকথা বলেই কাটে আমাদের ।

[2] কুয়াকাটার আপ্যায়ন নামক রেষ্টুরেন্টটায় কেউ যদি একবার লটপটি খায় এটা স্বীকার করে নেয়া তার কর্তব্য হবে বলে মনে হয় যে এর চেয়ে কুখাদ্য সে সারাজীবনে খায় নি । অনেকে মনে করবেন বাড়িয়ে বলছি কিন্তু আমাদের ছয়জনের এই রেষ্টুরেন্টটায় খেয়ে এটাই মনে হয়েছে । সারারাত জার্নির পর সকালে হোটেলে পৌছেই লাগেজপত্র রেখে বেড়িয়ে পড়লাম ব্রেকফাষ্টের সন্ধানে। যে হোটেলে উঠেছি তার সামনেই একটা রেষ্টুরেন্ট দেখলাম "হোটল আপ্যায়ন" । দেখি বাহিরে চুলায় গরম গরম নান ভাজা হচ্ছে । পেটে সবার ক্ষুধা এত বেশি ছিল যে মনে হচ্ছিল আস্ত এক ডেকচি নান সাবার করে ফেলা যাবে । তাড়াতাড়ি রেষ্টুরেন্টে ঢুকে নান-লটপটির অর্ডার দিলাম । একজন দিল ভাত-মুরগীর অর্ডার। লটপটি-মুরগীর নামে যে খাদ্যবস্তু এল আমি হিসেব করে তার একটা প্রস্তুতপ্রনালী বের করেছি-

একটি ডেকচিতে (হোটেলের রান্না ,বিস্তর লোকজন খাবে ডেকচি তো লাগবেই)পানি নিন । সমুদ্রের পানি হলে ভাল হয় তাতে লবনের খরচটা খানিকটা বাঁচবে । এই পানিতে ফালিফালি করে আলু কেটে দিন যাতে গড়ে প্রতি বাটিতে দুই-তিন ফালা করে আলু পড়ে । এবার এতে লবন-মরিচের গুড়া-তেল-নূন-মসলা ঢালুন । এসব ঢালার সময় খেয়াল রাখবেন এদের পরিমান যেন খুব বেশী না হয় আবার এমন কমও না যে কেউ খেলে বুঝতে পারবে যে এসব কিছুই দেয়া হয় নি অর্থাৎ এমন পরিমান হবে যাতে খেয়ে বোঝা যাবে লাল কাঁকড়ার জন্য খোড়া হচ্ছেলাল কাঁকড়ার জন্য খোড়া হচ্ছেলবন-ঝাল-তেল জাতীয় জিনিসপত্র আছে কিন্তু স্বাদ বোঝা যাবে না । যাই হোক এরপর মিশ্রনটাকে উৎকৃষ্টরূপে জাল করতে হবে যাতে এটা হাল্কা গাঢ় হয় , খুব বেশী গাঢ় করার দরকার নাই জানেনই তো কাষ্টমার ঝোল বেশী খায় , বেশী গাঢ় করতে গেলে ঝোল কমে যাবে । এরপর স্পেসিফিক্যালি ঠিক করতে হবে আপনি কি রান্না করতে চাচ্ছেন । যদি ডিম রান্না করতে চান তবে ডিম সিদ্ধ করে খানিকক্ষন পিঁয়াজ-তেলে ভেজে লাল হয়ে উঠলে তৈরী করে রাখা ঝোলে ছাড়ুন । ব্যস হয়ে গেল ডিম রান্না । কাঁকড়া পাওয়া গেছেকাঁকড়া পাওয়া গেছে লটপটি রান্নার কষ্ট আরও কম । মুরগী ছেলার সময় খেয়াল রাখবেন নখগুলোও যাতে নেয়া হয় (খামাখা এটা ফেলে লাভ কি,কাষ্টমারই তো খাবে !)। নখগুলোর উপরের হাল্কা চামড়াও ছাড়ুন । এবার মুরগীর মাথা ,গলা,গিলা ,চামড়া এইসব মুরগী থেকে আলাদা করে নিন। এবার মৃদু আঁচে মুরগীর এই জিনিসগুলোকে ভাপিয়ে নিতে হবে । অযথা চুলার লাকরি খরচ করার দরকার নাই এজন্য । ভাত যখন রান্না করবেন তখন ভাতের উপর জিনিসগুলো দিয়ে দিন । ওতেই এগুলো আধাসিদ্ধ হবে । এবার আধাসিদ্ধ জিনিসগুলো আগেই তৈরি করে রাখা আলুর ঝোলটাতে দিন । ব্যস তৈরী হয়ে গেল মুরগীর লটপটি।

কেউ বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা এরকম রেসিপিরই একটা লটপটি আমাদের মনে হয় খেতে হয়েছিল আপ্যায়ন হোটেলে । খাওয়ার পর কেউ বলল বমি বমি লাগছে ,কেউ বলল সারা জিন্দেগীতে এর মত কুখাদ্য খায় নি । একটা বিষয়ে সবাই একমত হল যে আর যাই হোক না খেয়ে মারা যাবে সবাই তবুও ঐ রেস্টুরেন্টে আর খাবে না । দুপুরে খাওয়া হল ঐ হোটেলের পাশের হোটেলটায় । সেটাতে অবস্থা এত খারাপ না হলেও খুব একটা সুবিধার না । বাহিরে খাওয়া-দাওয়ার এত অসুবিধা বিধায় সিদ্ধান্ত হল আমরা যে হোটেলে উঠেছি ওখানেই খাই । ওখানে কয়েকবেলা খেতে-খেতে পকেটের এমন হাল হল যে ঢাকায় ফেরাই দুরূহ হয়ে পড়ল। ঐ হোটেলের মালিক নাকি জার্মানী থেকে ট্যুরিজমে পড়াশুনা করে এসেছেন । আসার সময় সাথে করে এনেছেন এক বাবুর্চি । নাস্তার বিল না অন্য কিছু !নাস্তার বিল না অন্য কিছু !মালিক মনে হয় বাবুর্চির বেতন পর্যটকদের খাইয়ে সেখান থেকে আদায় করার কথা ভেবেছেন । একজন খাওয়ার মত একবাটি ডাল বিশ টাকা , সবজী পঁচিশ টাকা । একটা পরাটা খাবেন সেটাও আট টাকা করে , চায়ের দাম দশ টাকা । সকালে ডিম-পরোটা-ডাল-চা নাস্তা করলেই বিল আসে সবাই মিলে পাঁচশ টাকার কাছাকাছি । আলুভর্তা-ডাল-ভাতের বিল সাড়ে চারশ পেরিয়ে যায় । মাছ-মাংসের কথা না হয় নাই বলি । ওগুলো হাজার টাকার নিচে পাওয়ার নয় । এই রকম বিল আর যাই হোক আমাদের মত বেকার ছাত্রদের খুব বেশীদিন দিতে পারার কথা নয় । হলও তাই । চার-পাঁচ বেলা খাওয়ার পর মনে হল এবার ক্ষান্ত হওয়া প্রয়োজন , না হলে সাথের জিনিসপত্র বিক্রি করে ঢাকায় ফিরতে হবে । অতপর অনেক খুঁজে-পেতে ,অনেকের কাছে শুনে একটা সস্তা এবং ভাল হোটেলের খোঁজ পাওয়া গেল । হোটেল আমতলী । এক বৃদ্ধ লোক হোটেলটার দেখাশুনা করেন , অপরিচিতদের "কাহা" বলে ডাকেন । কাহা কি খাবেন ?কাহা আর কিছু লাগব? এই হোটেলের খাবার বেশ ভাল এবং সস্তা । আগেরটার নাস্তার বিল দিয়ে এখানে দুপুর আর রাতের খাবার আমিষ সহযোগে খাওয়া যায় । আমরা থাকতেই বুয়েটের আরেকটা গ্রুপের দেখা হয় কুয়াকাটায় । ওদেরকেও আমরা এই হোটেলটিতে খেতে বলি । কুয়াকাটা থেকে ঢাকায় ফেরার সময় বরিশালে কয়েকঘন্টার জন্য যাত্রাবিরতি নিতে হয়েছিল । এখানে একটা খাবার হোটেল আছে "হোটেল নাজ গার্ডেন" । এখানকার মোরগ-পোলাও আর কাচ্চি বিরিয়ানীও বেশ ভাল ।