কুয়াকাটা-০৩

[১]মিশ্রিপাড়ায় গেছি বৌদ্ধমন্দির দেখতে । এত বড় গৌতমের মূ্র্তি নাকি বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই । দেখলাম , বেশ বড়ই মূর্তিটা । এরপর মিশ্রিপাড়ায় রাখাইনদের পাড়ায় একটু হানা দিয়ে একটা স্কুলের সামনে এসে পড়লাম । প্রাথমিক বিদ্যালয় প্লাস হাইস্কুল দুটোই একসাথে । আমরা স্কুলের সামনে দাড়িয়ে স্কুলটা দেখছিলাম আর খোশগল্প করছিলাম । এমন সময় ক্লাসরুম থেকে একজন শিক্ষক বেড়িয়ে আসেন । হ্যালো,আই আম এন এসিসটেন্ট ইংলিশ টিচার অব দিস স্কুল । আমরা কুয়াকাটায় সাইপ্রাসিয়ান বাংঙালি ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে যেরকম অবাক হয়েছিলাম তার চেয়েও বেশী অবাক হয়ে পড়ি । ব্যাপার কি ? সবাই ইংলিশ কয় ক্যা? আমরা বলি ও , আচ্ছা । ভদ্রলোক এবার স্কুলের গুনগান গাইতে শুরু করেন। দিস স্কুল হ্যাজ এ গুড রেজাল্ট ইন এস,এস,সি এক্সামিনেশন । লাষ্ট ইয়ার এইট স্টুডেন্টস ফ্রম দিস স্কুল গট A+ অ্যান্ড টু অব দেম ওয়ার গোল্ডেন A+ । আমরা বলি ,ও আচ্ছা , বেশ ভাল রেজাল্ট তো । ভদ্রলোক এবার বলেন, ইউ ওয়ান্ট টু সী সামথিং মোর অব দিস স্কুল ? আমরা একটু ইতস্তত করি । না মানে ইয়ে ......। অবশেষে আমাদের মধ্যে একজনের আগ্রহে হ্যাঁ বলি । উনি আমাদের সাথে করে হাইস্কুলের একটা কামড়ায় নিয়ে যান । রুমে চার-পাঁচটি বেঞ্চ বসানো । এর মধ্যে সমকোনে রাখা দুটি বেঞ্চে বসে পাঁচ-ছয়জন ছাত্র পড়ালেখা করছে । ভদ্রলোক বলতে শুরু করেন । দিস স্টুডেন্টস উইল অ্যাপিয়ার ইন দ্যা জুনিয়র স্কলারশিপ এক্সামিনেশন দিস ইয়ার । আই অ্যাম ট্রাইয়িং টু টেক এক্সটা কেয়ার অব দেম এন্ড ট্রাইয়িং মাই লেভেল বেষ্ট । ইউ ক্যান টেষ্ট দিস স্টুডেন্টস । আমরা বলি , না , ঠিক আছে । কিন্তু ভদ্রলোক ক্ষাম্ত দেন না । প্রথম বাংলা শুনি এবার আমরা তার মুখে । এই ট্রান্সলেশন কর, আমি একজন ইন্জিনিয়ার হতে চাই ......। তিনি আবারো ইংরেজী শুরু করেন । ইউ ক্যান আস্ক দেম অ্যাবাউট দেয়ার এমবিশন অব দেয়ার লাইফ । আমাদের কথা বলার আগেই ছাত্রদের বলেন, টেল ইন ইংলিশ হোয়াট ইউ ওয়ান্ট টু বি ইন ইওর লাইফ । ছাত্ররা একজন একজন করে দাড়ায় আর বলে কে জীবনে কি হতে চায় । কেউ ডাক্টার হতে চায় , কেউ ইন্জিনিয়ার । ভদ্রলোক ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন , দিস পিওপল আর ফ্রম বুয়েট এন্ড দে আর গোয়িং টো বি ইন্জিনিয়ার । ইফ ইউ ওয়ার্ক হার্ড ইউ ক্যান অলসো গো দেয়ার । ছাত্ররা মাথা নাড়ে । ইয়েস স্যার । আমাদের নিয়ে ভদ্রলোক বেড়িয়ে পড়েন । ইফ ইউ হ্যাভ টাইম ইউ ক্যান মিট আওয়ার হেডমাষ্টার । আমরা বলি , না ,ঠিক আছে , আজকে আর না । প্রাইমারী স্কুলটার মনে হয় টিফিন চলছিল । খোলা মাঠে অনেক ছাত্রছাত্রী খেলাধুলা করছিল । আমরা বলি , এসো তোমাদের সাথে ছবি তুলি । সবাই এরা ছবির জন্য দাড়িয়ে যায় । ডিজিটাল ক্যামেরার ক্লীক শুনেই সবাই দৌড়ে যায় অমরের কাছে । সেই ছবি তুলছিল । সবাই ছবি দেখতে চায় । সবাইকে ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখিয়ে মুক্তি পেতে হয় ।

[২]বাহিরে কোথাও বেড়াতে গেলে সবাই মিলে টাকা-পয়সা দিয়ে আমরা একটা ডেটাবেস তৈরী করে নেই । যাতায়াতের ভাড়া ,হোটেল ভাড়া ,খাওয়া খরচ এইসব এই ডেটাবসে থেকেই দেয়া হয় । আর প্রতিবার এই ডেটাবসের ম্যানেজারের কাজটা আমাকেই করতে হয় । এবারও ম্যানেজার ছিলাম কিন্তু এবার দু-একটা ছোটখাট ঘটনা ঘটে গেছে এবং এ থেকেই বুঝে গেছি বয়স বাড়ছে , বুড়ো হয়ে যাচ্ছি । এধরনের ভুল সাধারনত বুড়োদেরই হয় ।

ঘটনা-১ : ফাতরা বনে যাব । নদী আর সাগরের একটা মোহনা পাড় হতে হয় ট্রলার দিয়ে । ট্রলার ভাড়া ঠিক হল ৩৫০ টাকা । ফাতরা বনে গিয়ে ট্রলারওয়ালারা ৫০ টাকা চাইল , চা-নাস্তা খাবে । দিলাম । ফাতরা বন থেকে ফিরে এসে ৩০০ টাকা দিতে হবে । খুচরা টাকা নেই , সব পাঁচশো টাকার নোট । ট্রলারওয়ালা একটা দোকানে নিয়ে গেল । দোকানদার ২০০ টাকা দিল ৫০০ টাকার নোটটা নিয়ে । আমরা ভ্যানে চড়ে রওয়ানা হলাম কুয়াকাটার দিকে । মিনিট ত্রিশেক হওয়ার পর পিছনে কার জানি উচ্চস্বরে ডাক শুনে দুটা ভ্যানই থামানো হল । দেখি সাইকেল নিয়ে ট্রলারওয়ালা এসে হাজির । বুঝলাম ঝামেলা আছে । হয়ত যে পাঁচশ টাকার নোটটা দিয়েছিলাম সেটা জাল । মাইর আজকে একটাও বোধহয় মাটিতে পড়বে না। ট্রলারওয়ালা অনেক জোরে সাইকেল চালিয়ে এসেছে । সে এসেই হাঁপাতে শুরু করল , আপনাদের মধ্যে কে টাকা দিল তখন । একজনকে দেখিয়ে বলল আপনি না । সেই একজনও বোধহয় ভয় পেয়ে গেল । সে বলল না আমি না । আমি তখন আর সরাসরি ট্রলারওয়ালাকে বললাম না আমি দিয়েছি টাকা তার বদলে বললাম কেন কি হয়েছে ? সে বলল টাকা তো দেননি । আমি আকাশ থেকে পড়লাম । কেন পাঁচশ টাকার নোট যে দেওয়া হ , দিয়ে দুইশ টাকা নেওয়া হল । না টাকা দেননি , দেখেন । আমি মানিব্যাগ বের করে টাকাগুলা গুনলাম । না আসলেই টাকা দেয়া হয় নি । একটা পাঁচশ টাকার নোট বেশী দেখা যাচ্ছে । ট্রলারওয়ালার কাছে মাফ-টাফ চেয়ে নোটটা দেয়া হল।

ঘটনা-২ : প্রতিটা বীচেই বীচের পাশে মনে হয় শামুক-ঝিনুকের দোকান থাকে । এখানেও আছে । পোলাপান সবাই মিলে হল্লা করে নানান জিনিস কিনল সেখান থেকে । আমিও দুয়েকটা জিনিস কিনব বলে দোকানে গেলাম । কি কিনি ? কেনার মত কিছুই না পেয়ে তিনটা ঝিনুকের মালা কিনলাম । এই মালা দেওয়ার মত কেউ নাই ,এমনকি ছোটবোনও নাই যে দেব । তারপরেও কেনা । দোকানে টাকা পয়সা দিয়ে মালার প্যাকেটটাও মনে হল নিয়েছি কিন্তু ত্রিশ-চল্লিশ পা যাওয়ার পর মনে হল আসলে প্যাকেটটা আমার কাছে নাই । সামনে সবাই দাড়িয়ে ছিল । এদের বললাম ঐ তোরা আমার প্যাকেটটা নিছস নাকি?

-কিসের প্যাকেট?

-ঐতো কয়েকটা জিনিস কিনছিলাম ঝিনুকওয়ালদের দোকান থেকে । ঐ প্যাকেটটা কি তোদের কাউকে দিছি । তোরাও তো আশেপাশে ছিলি ।

-কি কিনছিলি ? অনেকের প্রশ্ন । খাজনার চেয়ে বাজনা বেশী হলে যা হয় আরকি।

-ঝিনুকের মালা কিনছিলাম কয়েকটা ।

-কারে দিবি ? এর আগেও কক্সবাজার থেকে যে মালাগুলি কিনছিলি তার খবর কি? কারে দিসছ ?

-কাউরে দেইনি । আছে , আমার কাছেই আছে । বউরে দিমু । এবারের গুলাও বউরে দিমু ।

-বউতো নাই ।

-আরে ব্যাটা আজকে বউ নাই বইলা যে কালকে হইব না তার কি গ্যারান্টি । এত প্যাঁচাইতেছোস ক্যা ? মালা কাউরে যদি দিয়া থাকি তো ক ।

সবাই একসাথে হেসে ওঠে ।

- আর হইছে বউ । এহন পর্যন্ত প্রেমই করতে পারলি না..................। না আমাদের মালা দিস নি । ঐ দোকানেই আবার যা খুঁইজা দেখ ।

আবার মালার দোকানটাতে যাই । দোকানদারকে বলি ভাই দেখেন তো আশেপাশে খুঁজে । মালার প্যাকটটা মনে হয় নেই নাই । এখানেই কোথাও ফেলে গেছি মনে হয় । দোকানদার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আশেপাশে খোঁজে । কোথায় আর থাকব , আপনে তো নিয়াই গেলেন । দোকানদার প্যাকেটটা আর খুঁজে পান না । দোকানদারের সাথে একজন লোক বসে ছিলেন । তিনিও বলেন তার নাকি স্পষ্ট মনে আছে আমি দোকান থেকে প্যাকেটটা নিয়ে বের হয়েছি । আমি মনে মনে বলি ভাই আমারওতো স্পষ্ট মনে আছে আমি প্যাকেটটা নিয়েই বের হৈছি । কৈ রাখলাম । পরীর আছর পড়ল নাকি ? প্যাকেটটা আর পাওয়া যায় না ।

নিজের খবর আর নিজে রাখতে পারছি না । বিশেষ কাউকে মনে হয় খুব দরকার !