মির্জা গালিব : : গালিবের একটি চিঠি

মির্জা গালিব, উর্দু ভাষার সেরা কবি, শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি। গালিব শুধু তার কবিতার জন্যই বিখ্যাত ছিলেন না, বিখ্যাত ছিলেন তার বেপোরোয়া জীবনযাপনের জন্য, মদ, নারী আর জুয়ার প্রতি তীব্র আসক্তির জন্য। এই জিনিসগুলোকে গালিব শুধু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশই মনে করতেন না , মনে করতেন কবি হয়ে ওঠার মাধ্যম, কবিদের শক্তি। একবার কেউ একজন তার সামনে সমকালীন আরেক কবি শাহবাই এর কবিতার প্রশংসা করলে তিনি বলে ওঠেন "কী করে শাহবাই একজন কবি হতে পারে ? সে কখনও মদ পান করেনি ,জুয়া খেলেনি, প্রেমিকার চটির আঘাত খায়নি, কিংবা একবারের জন্যও কয়েদখানায় যায়নি। গালিবের জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৭৯৭ সালে আগ্রাতে। গালিবের প্রথম জীবন সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে তেমনকিছু জানা যায়না, জানা যায়না তার পড়াশুনা সম্পর্কেও। ১৮৩০ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে গালিব বিয়ে করেন। বিবাহিত জীবনে সাত সন্তানের জনক হলেও তার একটি সন্তানও বাচেঁনি। এটা নিয়ে গালিবের একটা মর্মবেদনা ছিল এবং তার গজলগুলোতে তা ফুঁটে উঠেছে। আগাগোড়া দাম্ভিক একজন কবি ছিলেন গালিব বাহদুর শাহ জাফরের সভাকবি জওকের সাথে তার বিরোধ ছিল সমকালীন অন্যতম প্রধান আলোচনার বিষয়। গালিব সর্বদাই ভাবতেন জওকের চেয়ে উত্তম কবি হলেও তিনি সভাকবির পদ পাচ্ছেননা নিতান্তই সম্রাটের অদূরদর্শিতার জন্য যিনি নিজে একজন কবি ছিলেন এবং জওককে গুরু মনে করতেন, জওককে বসিয়েছিলেনও গুরুর আসনে সভাকবি বানানোর মাধ্যমে। কিন্তু গালিব কখনও ছেড়ে কথা বলেননি । বাহদুর শাহ জাফরেরপু্ত্র জওয়ান বখতের বিয়ের অনুষ্ঠানে বিয়ের অনুষ্ঠান বিবাদ শুরু হয় গালিবের কবিতার একটি লাইনকে কেন্দ্র করে যাতে তনি বলেছিলেন সমাবেশে এমন কোন ব্যক্তি নেই যে তার চেয়ে উত্তম কবিতা লিখতে পারে। এরকমই দাম্ভিক ছিলেন গালিব। এসময় একজন কবির মন্তব্য ছিল এরকম "কালাম-ই-মীর সমঝে আউর জুবান-ই মির্জা সমঝে মগর ইনকা কাহা ইয়ে খুদ হি সমঝে ইয়া খুদা সমঝে" সরলীকরন করলে দাড়ায় এরকম "আমরা মীরের(আরেক কবি) কবিতা বুঝি,আর মির্জার ভাষা বুঝি কিন্তু তাকে ( গালিব )- তার কবিতা শুধু তিনিই বোঝেন কিংবা হতে পারে শুধু আল্লাহ বুঝতে পারেন।" শেষপর্যন্ত অবশ্য সভাকবি হতে পেরেছিলেন গালিব কিন্তু তা জওকের মৃত্যুর পর ১৮৫৪ সালে। গালিবের মদ ও নারীপ্রীতির কথা আগেই বলেছি , নিচের পত্রটি পড়লে তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন তার এক ঘনিষ্ট বন্ধুকে, বন্ধুর স্ত্রীর মৃত্যুর খবর জানিয়ে লেখা চিঠির উত্তরে " মির্জা সাহেব আপনি যেভাবে দিন কাটাচ্ছেন তা আমি পছন্দ করতে পারছি না । আমার কামনাময় যৌবনের দিনগুলোতে একজন জ্ঞানী লোক আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন , 'ইন্দ্রিয়সম্ভোগে নিবৃতি আমি অনুমোদন করিনা , কামুকতাকে আমি নিষেধ করিনা । খাও, পান করো এবং খুশি থাক । কিন্তু একটা জিনিস মনে রেখ ,বুদ্ধিমান মাছি চিনির ওপরে বসে , মধুর ওপরে নয়। আমি সবসময় তার পরামর্শ অনুসারে কাজ করেছি। আরেকজনের মৃত্যুতে তুমি শোক আদায় করতে পারো না , যদিনা তুমি নিজের ওপর বেচেঁ থাকো । আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো যে তিনি তোমাকে মুক্তি দিয়েছেন। আমি যখন বেহশতের কথা ভাবি এবং মনে করি যে আমার পাপগুলো যদি ক্ষমা করে দিয়ে আমাকে একজন হুরসহ একটি প্রসাদে স্থান দেয়া হয়, সেই মহিমান্বিত রমণীর সাথে চিরকাল কাটানোর জন্য আমার হৃদয় হতাশা আর আতংকে পূর্ন হবে। তাকে সেখানে দর্শন করা কী ক্লান্তিকর ও বিরক্তিকর - একজন পুরুষের বহন করার ক্ষমতার চাইতে অধিক বোঝা। আল্লাহ তাকে যাবতীয় ক্ষতি থেকে রক্ষা করুক - সেই একই পুরনো হুরি আমার বাহুবন্ধনে। একটু বোঝার চেষ্টা করো ভাই ,আরেকজন নাও। প্রতি বসন্তের শুরুতে একজন নতুন রমনী নাও কারন , গত বছরের হিসাব অর্থহীন বিষয়।" গালিবের মৃত্যু হয় ১৮৬৯ সালে ৭২ বছর বয়সে। --------------------------------------------------------- তথ্যসূত্র:[১]উইলিয়াম ড্যালরিম্পেল,The last Mughal[২]HERMANN KULKE, DIETMAR ROTHERMUND ,A History of India [৩]A L BASHAM ,A Cultural History of India