বুয়েটকথন-পরীক্ষা আসিতেছে(০১)

কিছুদিন আগে পর্যন্ত পরীক্ষা পেছানোটা একটা ঐতিহ্যর মত পালিত হত বুয়েটে।প্রতিটি টার্মের ক্লাস শেষে পরীক্ষা আসত আর সবাই জানত পরীক্ষা পেছাচ্ছে।সম্ভবত শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমহোদয়রাও জানতেন ব্যাপারটা।এজন্য আমরা প্রথমে সাদা কাগজে ছাপানো রুটিন পেতাম,যা আমাদের বোঝাতো আর মাত্র সপ্তাহ দুই পরই পরীক্ষা।আমরা বুঝতে পারতাম পরীক্ষা পেছাবে তবে তার জন্য একটু কাটখড় পোড়াতে হবে ।কাটখড় বলতে এই একটু মিছিলে নামতে হবে আরকি।সুতরাং সারাদিন পড়াশুনা করে (বলাতো যায়না যদি পরীক্ষা না পেছানো যায় কোনমতেই,ঝুঁকি কেইবা নেবে !)রাত্রে বারোটার দিকে মিছিলে নামতে হত একটু(বুয়েটে মিছিল হলে রাত্রেই হয় যাতে স্যাররা কাউকে না দেখে!)।স্যাররা দয়াপরবশ হয়ে পরীক্ষাটা দিতেন সপ্তাখানেক পিছিয়ে এবং দিতেন সবুজ কাগজে লেখা একটা রুটিন।আমরা বুঝতাম আর একটু চাপাচাপি করলে আরএকটু মেওয়া ফলবে।মেওয়ার আশায় আর একটা মিছিল হত এবং পরিশেষে আসত লাল কাগজে রুটিন,পরীক্ষা পেছাত আরও সপ্তাহখানেক।লালবর্ণী রুটিন চূড়ান্ত সংকেত মনে করে প্রবলবেগে পড়ালেখা চালিয়ে যেতাম আমরা।পরীক্ষা পেছানোতে বুয়েট ছাত্ররা বিশেষভাবে পারদর্শী এবং আন্তর্জাতিকভাবে(!) খ্যাত,২০০৬ এর ফুটবল বিশ্বকাপে খোদ স্বাগতিক দেশ জার্মানীতে কোন শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল না কোনদিন কিন্তু বু্য়েট বন্ধ ছিল পুরোটা সময়(মিথ্যা পড়েননি!পুরো বিশ্বকাপ দেখার জন্য বন্ধ দেয়া হয়েছিল)।আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে হায়রে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা কতই না ফুটবল অন্তপ্রান অথচ দেশের ফুটবলের কতইনা দুরাবস্তা!কিন্তু না এখানেই ভুল ভাবলেন।আসলে ঐ সময়ে পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল।আমি নিজে টিভিরুমে বসে সব খেলা দেখেছি কিন্তু আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের খেলা ছাড়া টিভিরুমে গোটা ত্রিশেক লোকের বেশী লোক পাওয়া যেত না।ঐ সময়ে আমরা দেশীয়তো বটেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ামহলে বিশেষ খ্যাতি(!!)অর্জন করেছিলাম।বেশ কিছু বিদেশী ক্রীড়া ম্যাগাজিন ও ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিল আমাদের ফুটবলপ্রীতির(!) কথা।অনেকে আবার ভাববেন না একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার উদাহরন দিচ্ছি।২০০২ এর ফুটবল বিশ্বকাপেও ঘটেছে একই ঘটনা।খেলাধুলাপ্রীতিই শুধু নয় পরীক্ষা আসলে আমরা মারাত্বক(!)রকমের দেশপ্রেমেও আক্রান্ত হই।এই যেমন ২০০৪ সনের বন্যার সময় যেটা ঘটল।আমরা গো ধরলাম বন্যার সময় দেশ যথেষ্ট দুরাবস্থায়,এসময় হল দেশমাতৃকার সেবা করার উৎকৃষ্ট সময়,এসময় পরীক্ষা দেয় কোন দুরাত্বা।সুতরাং হলে হলে পোস্টারিং করা হল,মিছিলও চলল কয়েকদিন, পরীক্ষাও পেছালো কয়েকদিন।কিন্তু পরদিন ক্যাফেটেরিয়াতে বন্যার্তদের জন্য রুটি বানানো কার্যক্রমে মিছিলের এক দশমাংশ ছাত্রকেও পাওয়া গেল না।হলে হলে চিরুনী অভিযান চালানো হল সাহায্যকারীর জন্য।নানান ছুতায় পরীক্ষা পেছাতে পেছাতে একবার নাকি(রুমমেটের কাছে শোনা) এমন অবস্থা হল ভিসি ঘোষনা দিলেন আর পরীক্ষাই নেবেন না,অনির্দিষ্টকালের পরীক্ষাবিরতি চলতে থাকল মাসখানেক ধরে।অবশেষে ছাত্রদের বিশেষ অনুরোধে(!) আরও দুই সপ্তাহ পর পরীক্ষা শুরু হল।আজ বু্যেটের যেটুকু সেশনজট তার পুরোটাই এই পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। কথা হল পরীক্ষা কেন পিছায়।যে ছাত্ররা বুয়েটে ঢোকার আগে পরীক্ষাকে মনে করত পরম আরাধ্য তারা কেন বু্য়েটে ঢুকে পরীক্ষা না দিতে পারলে বেঁচে যায়,মিছিলে নামে।এর উত্তর অনেকটা পরীক্ষা চলাকালীন ছাত্রদের মানসিক অবস্থার একটু বিশ্লেষণ করলেই পাওয়া যায়।আগামী পর্বে এবিষয়ে একটু লিখব। প্রথম প্রকাশ:http://www.sachalayatan.com/guest_writer/13879 সচলায়তন